দিশানায়েকের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ
২০২২ সালে প্রবল বিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ত্যাগ করে যাওয়ার পর অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাম নেতা অনুড়া কুমারা দিশানায়েকে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) দলের তরুণ নেতা দিশানায়েকে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শ্রীলঙ্কার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার নামের বাম জোটের প্রার্থী ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনৈতিক দলটি শ্রীলঙ্কার রাজনীতির দুর্বল ও প্রান্তিক অবস্থানে ছিল, সেই দলের প্রার্থী হয়ে দিশানায়েকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া দেশ ও বহির্বিশ্বে অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। শ্রীলঙ্কার রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলনেতা সাজিথ প্রেমাদাসা ও সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেকে পেছনে ফেলে নির্বাচনে জয়লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। অথচ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল দিশানায়েকের নেতৃত্বে বাম জোট। মাত্র পাঁচ বছরে সে দেশের মানুষের মনোভাবের এই আমূল বদলের কারণ হিসেবে প্রভাবশালী রাজাপক্ষে পরিবারের লাগামছাড়া স্বজনপ্রীতি ও ব্যাপক দুর্নীতির ফলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিকেই দায়ী করা হয়। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে রাজাপক্ষে পরিবার দেশ ত্যাগ করলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু যে অর্থনৈতিক সংকট রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভকে উসকে দিয়েছিল, তা খুব বেশি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি রনিল। ফলে রনিলের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে সে দেশের জনগণ ৫৫ বছর বয়সী দিশানায়েকেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে।
সাফল্যই একজন মানুষকে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত করে। ফলে দিশানায়েকে সম্পর্কে অনেকেরই জানার আগ্রহ জন্মাবে। অনেকেই জানতে চাইবে, কোন ক্ষমতাবলে দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনৈতিক অঙ্ক বদলে দিলেন তিনি। বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে জেভিপির রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন দিশানায়েকে। কারণ সে সময় কট্টর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক অবস্থান বজায় রেখে চলছিল দলটি। অবশ্য গত শতকের আশির দশকে সিংহলি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে দলটি। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের গায়ে পড়ে আগ্রহ দেখানো নিয়ে শ্রীলঙ্কার জনগণের ভেতর তখন ভারতবিরোধী মনোভাব বিরাজ করছিল। এই ইস্যুকে পুঁজি করে রাজনীতির কৌশল হিসেবে ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ’-এর কথা বলে শ্রীলঙ্কার আমজনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে জেভিপি। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮৭ সালে পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বলে ভারত ও শ্রীলঙ্কা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে তামিলদের বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। ভারত-শ্রীলঙ্কার মধ্যে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির বিরোধিতা করে জেভিপি। শুধু তা-ই নয়, দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র বিদ্রোহ গড়ে তোলে তারা। অতঃপর সত্তর ও আশির দশকে দুটি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল জেভিপি, যা দমন করতে সেনা নামিয়েছিল শ্রীলঙ্কান সরকার। বেশ কয়েক বছর ধরে চলেছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, অপহরণ ও গণহত্যায় দলের কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে দলের প্রতিষ্ঠাতা রোহানা উইজেবিরাসহ বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতারাও ছিলেন। জেভিপিকে নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন সরকার। সশস্ত্র পথেই জনগণের মুক্তি—এই ধারণা থেকে সরে আসেন তাঁরা। এমতাবস্থায় সহিংসতার পথ ত্যাগ করে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। জেভিপির রাজনীতির পথ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এরপরই মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করে বামপন্থী এই দলটি।
মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দলের ছাত্রসংগঠন থেকে রাজনীতিতে উত্থান হয় দিশানায়েকের। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি শ্রীলঙ্কার দুর্নীতি ও দুর্বল শাসনের কঠোর সমালোচক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। জনগণের সামনে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের চেয়ে নিজেকে ভিন্ন পরিচয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে যেতে থাকেন তিনি। এভাবেই দিশানায়েকে রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজনীতিতে তাঁর অর্জনও একেবারে কম নয়। ছাত্র বয়স থেকেই রাজনীতির শুরু করে ২০০০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকে কুমারাতুঙ্গা সরকারের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। তারপর একে একে প্রাণিসম্পদ, ভূমি ও সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সংসদে প্রধান বিরোধী হুইপ হিসেবে কাজ করেন। ২০১৪ সালে তিনি জেভিপির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা তাঁকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
তিনি কঠোর পরিশ্রম করে দলের আদর্শকে কর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে কর্মীদের উৎসাহিত করেন। দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর দিশানায়েকে সমাজের বিভিন্ন অংশকে সম্পৃক্ত করে একটি বৃহত্তর জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। দেশের উল্লেখসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ, সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যদের এই জোটে শরিক করতে সক্ষম হন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, একসময় যে দল এই ব্যক্তিবর্গকে গণশত্রু বিবেচনা করেছিল, তাঁদের নিয়েই তিনি ২০১৯ সালে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোট গড়তে সক্ষম হন। শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি) এবং ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)-এর বিকল্প মঞ্চ হয়ে ওঠে এই এনপিপি। স্বাধীনতার পর থেকেই এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে শাসন করে এসেছে ইউএনপি এবং এসএলএফপি। শ্রীলঙ্কার সুদীর্ঘ রাজনীতিতে এই দুটি দল বা জোটের একচ্ছত্র আধিপত্যকে ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দিশানায়েকে। মানুষ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। এবারের নির্বাচনে মেধাবী, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রতীক হিসেবে দিশানায়েকের ওপরই ভরসা রেখেছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, তাঁর এই সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো, দিশানায়েকের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। বর্ণনাতীত আর্থিক মন্দা-পরবর্তী সময় সে দেশের জনগণ চাইছিল নতুন নেতৃত্ব। ২০২২ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ‘মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন’-এর দাবিকে সামনে এনেছেন তিনি।
গত এক বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার পরপর তিনটি দেশ মালদ্বীপ, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতার পালাবদলের ফলে এই অঞ্চলের রাজনীতির গুণগত মানের কিছুটা পরিবর্তন ঘটছে। এ দেশগুলোতে ধীরে ধীরে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়। সর্বশেষ শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার পালাবদলের পর এ নিয়ে ভারত যে চিন্তিত, তা বোঝা যায়। তাদের চিন্তিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এই দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক। দিশানায়েকে বামপন্থী হওয়ায় ভারতের চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘ হবে—এটাই স্বাভাবিক। দিশানায়েকেকে বরাবরই ভারতবিরোধী বলে মনে করা হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দিশানায়েকের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই তালিকায় আছে দেশের অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি ও জাতিগত উত্তেজনার মতো অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার বিদেশনীতিকে তিনি কোন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং তার নিরিখে ভারতের সঙ্গে সে দেশের সম্পর্কইবা কোন পথে যাবে, সেটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
তবে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দিশানায়েকে চীন-ভারত সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তাঁর অবস্থানের যে পরিবর্তন ঘটেছে তা বলা যায়। নির্বাচনোত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় শ্রীলঙ্কা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। তবে আমরা ওই ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছি না। আমরা কোনো পক্ষের সঙ্গে জোটও বাঁধিনি। চীন ও ভারত উভয়েই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুরাষ্ট্র। এই দুই রাষ্ট্রের কৌশলগত লড়াইয়ে আমরা স্যান্ডউইচ হতে পারি না। এ দুই দেশই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু।’ ভবিষ্যতে দেশ চালাতে গিয়ে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা দিশানায়েকের অন্যতম কাজ হবে। এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কাটিয়ে তুলতে আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থার সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
No comments