প্রিয় আব্বা
প্রিয় আব্বা,
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে কালো মেঘের আনাগোনা। খানিক বাদে বাদে বয়ে যাওয়া হিমেল হাওয়ায় গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নগরের পথঘাটের নয়া বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে মিটিমিটি। এমন স্বর্গীয় পরিবেশে, মাঝেমাঝে দুয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে জানান দেয়, এখনো আমি বাংলাদেশেই আছি। স্বর্গে পৌঁছাইনি! আচ্ছা স্বর্গে কি কুকুর থাকবে,আব্বা? জানিনা।
কেমন আছো,আব্বা? আজ প্রায় এক যুগ হলো, তোমায় ডাকিনা। মাঝেমাঝে,তোমার জন্যে হৃদয়ে খুব শূন্যতা অনুভব করি, জানো? করবোই বা না কেনো? তুমি ছিলে আমার শৈশবের প্রথম বেস্টফ্রেন্ড। আমার এখনো মনে পড়ে, আব্বা। যখন প্রতি শুক্রবারে আমি তোমার সাথে বাজারে যেতাম, তখন যা চাইতাম তাই কিনে দিতে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি ললিপপ খেতে চাইলে তুমি আমার জন্যে একটা আর নিজের জন্যে একটা নিতে। জনসম্মুখে, আমার সাথে ললিপপ খেতে। তখন বুঝতাম না, আব্বা এতো বড় হয়েও কেন ললিপপ খায়। অথচ আজ বুঝি, সবই ছিলো আমাকে সঙ্গ দেয়ার বাহানা।
ছোটোবেলায়, টিভিতে র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) কে দেখে আমার র্যাবের পোশাকের প্রতি একটা আকর্ষণ জন্মেছিলো। সেটা তোমার কাছে ব্যক্ত করার পর, পরের দিনই রাতের বেলা আমার জন্যে তুমি র্যাবের পোশাক নিয়ে এলে। কালো শার্ট,কালো হাফ প্যান্ট,কালো চশমা। বাসায় এসে দেখলে আমি ঘুমিয়ে গেছি, আমাকে ঘুম থেকে তুলে ড্রেসের ট্রায়াল করতে লাগলে।
আমার এখন মনে হয়, তোমাকে, আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে তোমার দর্শনকে আমি বা পরিবারের কেউই বুঝে উঠতে পারিনি। সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্র হয়ে যেমন সূয্যিমামা ক্রমাগত কিরণ দিয়ে যাচ্ছে, তেমনি তুমিও এই ভোগবাদী দুনিয়ায় ত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলে। যেখানে প্রায় সব মানুষের ইচ্ছে থাকে প্রচুর পরিমাণে টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পত্তির মালিক হওয়ার; সেখানে তুমি চেয়েছিলে সবাই মিলেমিশে আনন্দে থাকা যায় এমন একটি পৃথিবীতে থাকতে। যেখানে টাকা-পয়সার জন্যে আজকাল বাবা তার ছেলেকে খুন করে,ছেলে তার বাবাকে খুন করে,ভাই তার ভাইকে খুন করে, সেখানে টাকা-পয়সার প্রতি তোমার কখনো কোনো আকর্ষণই ছিলোনা।
মাঝেমাঝে খোদার কাছে খুব করে অভিযোগ জানাতে ইচ্ছে করে জানো,আব্বা? যখন দেখি, একশো, নব্বই কিংবা আশি বছর বয়সী মানুষ এখনো পৃথিবীতে দিব্যি হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তুমি পঞ্চাশ পেরোবার ফুরসৎ ও পেলেনা। আজ একযুগ হলো কাউকে আব্বু বলে ডাকতে পারিনা। কাউকে আব্বু বলে ডাক দিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারিনা। কারো কাছে বায়না করে এটা-ওটা আবদার করতে পারিনা। হ্যাঁ,তুমি ঐ দূর আকাশের জ্বলজ্বল করা নক্ষত্র হবার পর আমার প্রায় সকল আবদার পূরণেই সচেষ্ট ছিল পরিবারের বাদবাকি সবাই। কখনো আমাকে তোমার শূন্যতা অনুভব করার ফুরসত দেয়নি কেউই। কিন্তু আব্বা একটা ভেঙে যাওয়া কাচের গ্লাসকে যদি পুনরায় সুপার গ্লু দিয়ে লাগানো হয় তাহলে কি তা আগের রূপ ফিরে পায়? আমার বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। সেই ছোট্টো সায়হাম যে আজ প্রায় একটা যুগ ধরে তোমাকে আব্বা বলে ডাকতে পারেনা- সেই ক্ষত সারিয়ে তোলার কি কোনো প্রতিষেধক আছে?
আব্বা, মানুষ যখন ইহকালের মায়া ত্যাগ করে খোদার কাছে চলে যায় তখন কি সে দুনিয়াতে তার পরিবারের কে কি করছে তা দেখতে পায়? আমি যে মাঝেমাঝেই উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি তা কি তুমি দেখতে পাও?খোদা তোমাকে বেহেশতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। ভালো থেকো আব্বা।
ইতি,
তোমার ছোট ছেলে।
০৪ঠা সেপ্টেম্বর,২০২৪
No comments