Adsterra

হিজবুল্লাহর প্রধান কে এই হাসান নাসরুল্লাহ

হিজবুল্লাহর প্রধান কে এই হাসান নাসরুল্লাহ, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news, bangladesh new

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ। তিনি লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে দীর্ঘ ৩ দশকের বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। আজ শনিবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, গতকাল শুক্রবারে বৈরুতে বিমান হামলায় নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। তবে হিজবুল্লাহ এই বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। 


ইসরায়েলি গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় নাসরুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরেই লোকচক্ষুর অন্তরালে। রহস্যময় এই ছায়ামানবের ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়ে গেছে। তাঁর নেতৃত্বেই হিজবুল্লাহ লেবাননসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এক বিশেষ অবস্থান অর্জন করেছে এবং আজকের এই অবস্থানে এসেছে। সমর্থকদের মধ্যে নাসরুল্লাহ ব্যাপক জনপ্রিয়। 


নাসরুল্লাহর নেতৃত্বেই হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস, ইরাক ও ইয়েমেনের মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছে। পাশাপাশি গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইরান থেকে পাওয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের বিশাল মজুত গড়ে তুলেছে। 


লেবাননে মূলত ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেখান থেকে নাসরুল্লাহ গোষ্ঠীটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। গোষ্ঠীটির সশস্ত্র শাখার আকার লেবাননের মূল সেনাবাহিনীর চেয়েও বড়। সামরিক শক্তিতে হিজবুল্লাহ লেবানিজ সশস্ত্র বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী। দেশটির ক্ষমতার অন্যতম ভারকেন্দ্র এই গোষ্ঠী। সামরিক শাখার বাইরেও গোষ্ঠীটি লেবাননের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সেবা খাতের প্রতিষ্ঠাতা। শিক্ষা, সমাজ সেবার এমন কোনো খাত নেই যেখানে হিজবুল্লাহর পদচারণা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে হিজবুল্লাহকে ইরানের সবচেয়ে বড় প্রক্সি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

 

সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৬০ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের পূর্বাঞ্চলের বুর্জ হাম্মাদ নামা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা বাবা আব্দুল করিম ছোট্ট একটি ফল ও শাকসবজির দোকান পরিচালনা করতে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বড়। 


লেবাননে ১৯৭৫ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আমল মুভমেন্ট নামে শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষে তিনি ইরাকের শিয়া ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র শহর নাজাফে একটি শিয়া আশ্রমে যোগ দেন। পরে তিনি আবারও আমল মুভমেন্টে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলার জবাবে ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ চালালে নাসরুল্লাহ আমল গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে আসেন। 


পরে তিনি ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) সহায়তায় গঠিত ইসলামিক আমল নামে একটি নতুন গোষ্ঠীতে যোগ দেন। লেবাননের বেকা উপত্যকাকেন্দ্রীক ছিল এই গোষ্ঠীটি। অল্প দিনের মধ্যেই গোষ্ঠীটি খ্যাতি অর্জন করে এবং শিয়া গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। যা পরে হিজবুল্লাহ নাম ধারণ করে। 


হিজবুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৫ সালে আত্মপ্রকাশ করে। সে বছর এক খোলা চিঠিতে গোষ্ঠীটি যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইসলামের মূল শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে, মুসলিমদের ভূমি দখল করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করায় ইসরায়েলের বিলুপ্তি চায়। 


হিজবুল্লাহর শক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসান নাসরুল্লাহরও পদমর্যাদা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তিনি হিজবুল্লাহর বালবেক অঞ্চলের পরিচালক নিযুক্ত হন। পরে পুরো বেকা অঞ্চলের। এরপর ১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহর তৎকালীন প্রধান আব্বাস আল-মুসাভি ইসরায়েলি হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হওয়ার তিনি মাত্র ৩২ বছর বয়সে গোষ্ঠীটির প্রধান নিযুক্ত হন। এরপর থেকে তিনিই গোষ্ঠীটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। 


নেতা হিসেবে তার প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল মুসাভির হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। তিনি উত্তর ইসরায়েলে রকেট হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে এক কিশোরী মারা যায়। তুরস্কে ইসরায়েলি দূতাবাসের একজন ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা গাড়ি বোমায় নিহত হন এবং আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাসে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৯ জন নিহত হয়। 


হিজবুল্লাহ ২০০০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে দক্ষিণ লেবাননে একটি স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ইসরায়েলি বাহিনী সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করলে এই যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে তাঁর বড় ছেলে হাদি ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। 


দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহারের পর ইসরায়েল দাবি করে, এই প্রথমবার কোনো আরব পক্ষ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জয়লাভ করল। সে সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হিজবুল্লাহ অস্ত্র সংবরণ করবে না। তিনি বলেন, শেবা ফার্মসহ লেবাননের যেসব জায়গা ইসরায়েল দখল করে রেখেছে তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত ছিল। সে বছর হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ শুরু করে যাতে ৮ ইসরায়েলে সেনা নিহত হয় এবং দুজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তারা। 


জবাবে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান লেবাননের দক্ষিণে এবং বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করে। একই সময়ে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে প্রায় ৪ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে। ৩৪ দিনে এই যুদ্ধে ১ হাজার ১২৫ জন বেসামরিক লেবানিজ, যাদের ১১৯ ইসরায়েলি সৈন্য এবং ৪৫ জন বেসামরিক লোক মারা যায়। এ সময় নাসরুল্লাহর বাড়ি ও কার্যালয়ে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান হামলা চালায় কিন্তু তিনি অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান। 


এরপর ২০০৯ সালে নাসরুল্লাহ একটি নতুন রাজনৈতিক ইশতেহার জারি করেন যা হিজবুল্লাহর ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ তুলে ধরে। এই ইশতেহারে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের গঠনের কথা বাদ দেয় গোষ্ঠীটি। কিন্তু ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখে। এই ইশতেহারে হিজবুল্লাহ এই দাবি পুনর্ব্যক্ত করে যে, দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহ সশস্ত্র অবস্থায় থাকবে। 


এর চার বছর পর, ২০১৩ সালে নাসরুল্লাহ ঘোষণা করেন, হিজবুল্লাহ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থনে বিদ্রোহ দমন করতে সিরিয়ায় যোদ্ধা পাঠাবে। ২০১৯ সালে লেবাননে গভীর অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, অপচয়, অব্যবস্থাপনা এবং অবহেলার অভিযোগে রাজনৈতিক এলিটদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। নাসরুল্লাহ প্রাথমিকভাবে সংস্কারের আহ্বানের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন, কিন্তু আন্দোলনকারী রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তনের দাবি করতে শুরু করলে তিনি মনোভাব পরিবর্তন করেন। 


এরপর, দীর্ঘদিন শান্ত অবস্থা বজায় রাখে হিজবুল্লাহ। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর চিত্র পাল্টে যায়। এই হামলার পরদিন গাজায় ইসরায়েলি হামলার জবাবে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট হামলা শুরু করে। গোষ্ঠীটি উত্তর ইসরায়েল এবং ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমিতে এখন পর্যন্ত ৮ হাজারের বেশি রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি সাঁজোয়া যানগুলোতে অ্যান্টি-ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্রও নিক্ষেপ করেছে এবং বিস্ফোরক ড্রোন দিয়ে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করেছে। 

No comments

Powered by Blogger.