Adsterra

শিশুর স্মার্টফোন আসক্তি বিপজ্জনক

শিশুর স্মার্টফোন আসক্তি বিপজ্জনক, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news, bangladesh news

শিশুরা কাদামাটির মতো। একজন মৃৎশিল্পী কাদামাটি থেকে যেভাবে দক্ষ হাতে সুন্দর ও নিপুণ জিনিস তৈরি করেন তেমনি বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা চাইলেও তাদের শিশুকে ঠিক সেভাবেই গড়ে তুলতে পারেন যেমনটা তারা চান।


আজকাল মা হওয়ার পর অনেককেই সাধের চাকুরি ছেড়ে দিতে দেখা যায়। বাচ্চার নাওয়া-খাওয়া নিয়ে তারা এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, নিজের যত্ন নিতে সময় পান না। একজন মা নিজের শখ-শৌখিনতা বজায় রেখেও সন্তানকে বড় করতে পারেন।


হাতের কাজ সামাল দেওয়ার জন্য বাচ্চার হাতে ফোন ধরিয়ে দেন অনেক মা-ই। অনেক সময়ে পাশের বাড়িতে খেলতেও পাঠিয়ে দেন। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে না পারার জন্য পরে হয়তো তাদের এটি নিয়ে অপরাধবোধও তৈরি হয়।


প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেমন অভাবনীয় বিপ্লব ঘটেছে, ঠিক তেমনি কিছু বিড়ম্বনাও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য স্মার্টফোন বেশ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

মোবাইল ফোন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। 


সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ শিশু স্কুলে ভর্তির আগেই (প্রি-স্কুল) স্মার্টফোনে আসক্ত, যার মধ্যে ২৯ শতাংশের মারাত্মকভাবে স্মার্টফোনের আসক্তি রয়েছে। বাবা-মা সন্তানদের সময় কম দেওয়ার কারণে ৮৫% শিশু স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে। খেলার মাঠের অভাবে ৫২%, খেলার সাথীর অভাবে ৪২% শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত হচ্ছে।


আধুনিক প্রযুক্তির এই যন্ত্রটির ফলে শিশুদের কথা না বলা এমনকি স্পিচ ডিলে (দেরিতে কথা বলা) সমস্যা, শিশুদের অন্য শিশুদের সঙ্গে কমিউনিকেশনের সমস্যা দেখা দেয়। মানসিক সমস্যা এমনকি অনেক সময় শিশুরা অটিস্টিকও হয়ে যায়। তাছাড়া এই মোবাইল স্ক্রিনের রেডিয়েশন থেকেও শিশুদের অনেক ক্ষতি হতে পারে।


বিশেষজ্ঞরা বলে, মোবাইল থেকে বাচ্চাদের একেবারে দূরে রাখতে হবে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এখন আমরা অনেক শিশু রোগী পাচ্ছি যাদের স্পিচ নেই, কেউ সামান্য শুধু মা-বাবা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। অন্যদের সঙ্গে ইন্টারেকশন করে না। মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণেই এটা হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে আরও আমাদের অনেক গবেষণা করা প্রয়োজন। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য মোবাইল একটি বড় সমস্যা।


এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু (বিএসএমএমইউ) বলেন, বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার অনেকাংশেই বেশি। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলের শিশুরা বেশি মোবাইল ব্যবহার করে। দেখা যাচ্ছে, এক-দুই বছরের বাচ্চারা বেশি মোবাইল ফোনে আসক্ত হচ্ছে। এক-দেড় বছরে বাচ্চারা কিছু কথা বলা শুরু করে। এ সময়টায় মোবাইলে আসক্ত হলে কথাগুলো হারিয়ে যায়, স্পিচ ডিলে সমস্যা, আবার অনেক বাচ্চা কথাই বলে না। প্রথম পাঁচ বছর একটি বাচ্চার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে। হাঁটা, বসা, চলা, কথা বলা ও বুদ্ধি হওয়া এগুলোর সবই তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়। এ সময়টাকে যদি কাজে লাগানো না যায় তাহলে সেটা আর কখনোই ফিরে আসবে না। এ বয়সেই বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশ ও সব ধরনের বৃদ্ধি ঘটে। পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে কথা বলতে, মস্তিষ্কের বিকাশে ও আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।


তিনি আরও বলেন, প্রথম পাঁচ বছর বাচ্চার মস্তিষ্ক থাকে একেবারে নরম কাদামাটির মতো। এ সময়ে তাকে যেভাবে যা বোঝানো ও শেখানো হবে, তাই শিখবে। পাঁচ বছরের পর বাচ্চার ব্রেন শক্ত হয়ে যায় তখন আর নতুন করে বিকাশ ঘটে না। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়স হচ্ছে বাচ্চার ব্রেনের বিকাশের সবচেয়ে ভালো সময়। সেই সময়টাতেই বাচ্চারা মোবাইল ধরার ফলে তাদের বিকাশ অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়।



অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে বাচ্চাদের স্ক্রিন ডিপেন্ডেন্সি সিনড্রোম তৈরি হয়। বাচ্চারা মোবাইলের প্রতি এতো বেশি ডিপেন্ডেন্ট হয় যে, তাদের মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত রাখা যায় না। মোবাইল ব্যবহার করতে না দিলে বাচ্চারা রাগান্বিত হয়ে যায়। কোনো কাজ করবে না, মারামারি করে, মন খারাপ করে থাকে। বর্তমানে অনেক বাচ্চাদের এসব অসুবিধা দেখা যাচ্ছে।


আমেরিকান পেডিয়াট্রিক সোসাইটির গাইডলাইনে বলা হয়েছে, প্রথম দুই বছর বাচ্চাদের মোবাইল দেওয়া যাবে না, তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের এক ঘণ্টা শুধুমাত্র শিক্ষামূলক কাজের জন্য মোবাইল দিতে হবে। পাঁচ বছরের পরে বাচ্চাদের মোবাইল দেওয়া যেতে পারে।\

ডা আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্য পরামর্শ বিষয়ক বই, আসুন সুস্থ থাকি, মানসিক স্বাস্থ্য, সিটি হেলথ সার্ভিসেস, মোহাম্মদপুর, Dr Abida Sultana, health, fitness,

                                                ডা আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্য পরামর্শ বিষয়ক বই


শিশুদের মোবাইল ব্যবহার কমাতে অভিভাবকের করণীয়:

মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরা বুঝে কিংবা না বুঝে শিশুদের হাতে অত্যধিক শক্তিশালী এ যন্ত্রটি তুলে দিচ্ছেন। তারা কখনো কল্পনাও করতে পারছেন না মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিয়ে সন্তানের ভয়ংকর সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনছেন। সুতরাং সর্বাগ্রে মা-বাবার সচেতনতাই শিশুর মোবাইল ফোন ব্যবহার কমাতে পারে।


শিশুদের মোবাইল ফোনের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে। সৃজনশীল কাজে যেমন- ছবি আঁকা, গল্প করা, নাচ-গান করা, পাজল খেলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মা-বাবাকে বাচ্চাদের সামনে মোবাইল ফোন ব্যবহার কমাতে হবে। শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প করতে হবে।


প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই আমাদের শিশুরা মোবাইলের আসক্তি থেকে মুক্তি পাবে ও নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে দেশের উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারবে।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. আকতারুজ্জামানের বলেন, শিশুদের অতিরিক্ত মোবাইল ফোনের আসক্তির কারণে প্রথমেই তাদের ভিশন সমস্যা হয়। বর্তমান সময়ে অনেক শিশুরই অল্প বয়সে অনেক হাই পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, একদম শুরুতেই শিশুদের দুই, তিন, চার, পাঁচ এমনকি ছয় পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। পাশাপাশি মোবাইলে আসক্ত হওয়ার ফলে শিশুদের চোখের রেটিনায় দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতির পরিমাণ এখন হয়তো বোঝা যাবে না, কিন্তু বাচ্চার বয়স যখন ১০-১২ কিংবা ১৫ বছর বয়স হবে তখন তার চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


অতিরিক্ত মোবাইল ফোন আসক্তির কারণে অনেক শিশুর চোখ টেরা (বাঁকা) হয়ে যায়। বাচ্চাদের যখন পাওয়ার যুক্ত চশমার প্রয়োজন হয় তখন তারা তা ব্যবহার করতে চায় না। আবার শিশুরা সঠিকভাবে চশমা ব্যবহার না করার ফলে চোখ টেরা বা বাঁকা হয়ে যায়। খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন এখন আমাদের দেশে বাঁকা চোখের শিশু অনেক বেশি, এর অন্যতম প্রধান কারণ মোবাইল আসক্তি।


একটি গবেষণায় নির্বাচিত ৪০০ শিশুর প্রত্যেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে। যাদের মধ্যে ৯২ শতাংশ তাদের বাবা-মায়ের স্মার্টফোন ব্যবহার করে ও ৮ শতাংশ শিশুর ব্যবহারের জন্য পৃথক স্মার্টফোন আছে। বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের থেকেও প্রায় তিন গুণ বেশি।


৭৩ শতাংশ মা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোন হাতে তুলে দিয়ে ব্যস্ত রাখেন কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই নিজেদের কাজ করার জন্য। ৭০ শতাংশ মা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেন কারণ তাদের বাচ্চারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করে। ৬৭ শতাংশ মা তাদের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য ও ৩১ শতাংশ মা শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।


এই গবেষণায় উঠে আসে, যেসব বাবা-মা প্রতিদিন তিন ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের সন্তানরা স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ গুণেরও বেশি। পেশাজীবী মায়েদের বাচ্চারা অধিকহারে স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে, কেননা তারা তাদের সন্তানদের প্রয়োজন অনুসারে সময় দিতে পারছেন না।

স্মার্টফোনে আসক্ত শিশুরা যারা আসক্ত নয়, তাদের তুলনায় মারাত্মক মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কম নয়, যা স্বাভাবিক বাচ্চাদের তুলনায় ২৩০ গুণ বেশি। শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে একটা সময় এটা অভ্যাসে বা আসক্তিতে পরিণত হয়। অনেক দিন ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে শিশুদের কারও কারও শারীরিক ও মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়।


শারীরিক সমস্যাগুলো হলো- ঘুমের অসুবিধা, পরিপূর্ণ ঘুম না হওয়া, পিঠ, কোমরে কিংবা মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা বা চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি রয়েছে। দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে- উদ্বিগ্নতা, অসততা, নিজেকে দোষী বোধ করা, অতিচঞ্চলতা ও হিংসাত্মক আচরণ করা। এসব শিশুরা সারাক্ষণ একা থাকতে ভালোবাসে। ফলে বাইরে যাওয়া, অন্যদের সঙ্গে মেশা, সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা ও সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলার প্রবণতাও কমে যায়।   


শিশুরা দেখে এবং অন্যদের সঙ্গে খেলতে খেলতে সব কিছু শেখে। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ নির্ভর করে পরিবেশ ও অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে শিশুদের কথা বলা, হাঁটা-চলা ও স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ হয়। এ সময়ে শিশুর দীর্ঘসময় স্মার্টফোনে গেম খেলা, ভিডিও দেখা, গান শোনা, আবার স্বাভাবিক খেলাধুলা না করায় শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।   


পাশাপাশি শিশুরা স্মার্টফোনে ভিডিও দেখতে দেখতে খাবার খেলে সেই খাবার শিশুর বিকাশে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখে না। যেকোনো খাবারের হজম প্রক্রিয়া শুরু হয় মুখের লালা থেকে। খাবার হজম হতে যেমন লালা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি মুখে লালা আসার জন্য খাবারটা দেখতে হয়, খাবারে মনোযোগ দিতে হয়। যেমন টক জাতীয় খাবার দেখলেই মুখে লালা আসে। বাচ্চারা যখন ভিডিও দেখতে দেখতে খায়, সে যদি খাবারটা না দেখে তাহলে মুখে লালা আসে না। লালা না এলে হজম প্রক্রিয়ার কিছু অংশ অসমাপ্ত রয়ে যায়। ফলে যেসব বাচ্চারা মোবাইলে ভিডিও দেখতে দেখতে খায় তাদের হজমে সমস্যা হয়, এতে বাচ্চাদের অনেক সময় ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।

No comments

Powered by Blogger.