ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে সীমার ৮ গুণ বেশি ঋণ নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ
ব্যাংক খাত থেকে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বিপুল ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে দেশের বড় শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরা। এমনকি আর্থিকভাবে রুগ্ণ হয়ে পড়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও নির্ধারিত সীমার ৮ গুণ বেশি ঋণ নিয়েছে গ্রুপটি। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ না করে ক্ষমতার দাপটে অভিনব সব সুবিধা নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে।
বিগত সরকারের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সহায়তায় এবং সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে অনিয়মের পাহাড় গড়ে ব্যাংক লোপাট করেছে বসুন্ধরা। জানা গেছে, পাচারের উদ্দেশ্যেই বিপুল ঋণ করেছে গ্রুপটি। কারণ কেবল ব্যবসায়িক কারণে এত অর্থ প্রয়োজন নেই শিল্প গ্রুপটির। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এ যাবৎ ৪২ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তা ছাড়া বেশিরভাগ ব্যাংকের শাখা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকায় ব্যাংকগুলো এটা নিয়েও নানারকম চাপে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ৩১ আগস্ট শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকে বসুন্ধরা গ্রুপের সরাসরি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ঋণসুবিধার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ কোটি টাকার (নন-ফান্ডেড)। সব মিলিয়ে গ্রুপটিকে সীমার প্রায় ৮ গুণ বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। আইন ভেঙে বসুন্ধরাকে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে বিভিন্ন সময় বিশেষ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। এখন এসব ঋণের কারণে ব্যাংকটি সংকটে পড়েছে।
হিসাব অনুযায়ী, বসুন্ধরা পেপার মিলস ও বসুন্ধরা মাল্টি পেপারের ঋণ ৮১০ কোটি টাকা। মেঘনা সিমেন্ট মিলস, বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ও বসুন্ধরা ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ঋণ ১৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ঋণ ১৯০ কোটি টাকা, বসুন্ধরা মাল্টি ফুডের ৯৬৪ কোটি টাকা, বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিংয়ের ১৫৬ কোটি টাকা ও বসুন্ধরা এয়ার ওয়েসের ঋণ ৩৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানির ঋণ ৬৭৯ কোটি টাকা এবং বসুন্ধরা ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানির ঋণ ৮৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বসুন্ধরা মাল্টি ফুডের ঋণসুবিধা ১৪ কোটি টাকা। তথ্যানুযায়ী, এর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের ২৮টি কিস্তি বকেয়া রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একটি ব্যাংক থেকে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কী পরিমাণ ঋণ ও ঋণসুবিধা নিতে পারবে, তা ব্যাংক কোম্পানি আইনে নির্দিষ্ট করা আছে। এতে বলা হয়েছে, একটি গ্রুপকে কোনো ব্যাংক সরাসরি ঋণ হিসেবে তার পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশ এবং ঋণসুবিধা অর্থাৎ ঋণপত্র, গ্যারান্টি ইত্যাদি হিসেবে ১০ শতাংশ অর্থ দিতে পারবে। সেই হিসাবে ন্যাশনাল ব্যাংক বসুন্ধরা গ্রুপকে ৪৮২ কোটি টাকা সরাসরি ঋণ ও ৩২১ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দিতে পারে। বসুন্ধরা গ্রুপ আইন অমান্য করে বিশেষ সুবিধা নিয়েছে।
তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। গ্রুপটির শীর্ষ নির্বাহীরা বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানি পরিচালনা করছেন। ঋণের নামে ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের চার দিন আগে দেশের বসুন্ধরা গ্রুপকে দুই বছর ঋণ পরিশোধ না করার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণের জন্য গ্রুপটি এই সুবিধা পেয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের পীড়াপীড়িতে গত ৩১ জুলাই এ-সংক্রান্ত চিঠি ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এর আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সময় বিশেষ সুবিধাটি ছিল পুনঃতফসিলের দ্বিতীয় ঘটনা। অর্থাৎ এর আগেও সুবিধা নিয়ে ঋণ পরিশোধ করেটি গ্রুপটি। প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। অর্থাৎ সরকার পতনের মাত্র ৪ দিন আগে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঠানো ওই চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দেয়, ‘এ অনুমোদন ব্যাংকের অন্য কোনো গ্রাহকের বা অন্য কোনো ব্যাংকের অন্য কোনো গ্রাহকের ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে নজির হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।’ ফলে বসুন্ধরা গ্রুপের জন্য দেওয়া এই সুবিধাকে বিরল হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, গ্রুপটির কর্ণধাররা সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের শুরুতে বসুন্ধরা গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। গত এপ্রিলে ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকে আবেদন করে তারা। আবেদনে গ্রুপটি সাত বছরের জন্য দ্বিতীয়বার ঋণের পুনঃতফসিল এবং দুই বছর ঋণ ও কিস্তি পরিশোধে বিরতি চায়।
২০২২ সালে খেলাপি ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নীতিমালা করেছিল, তার আলোকে এই সুবিধা চায় গ্রুপটি। করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য এই নীতিমালা করা হয়েছিল। ওই নীতিমালায় বলা হয়, এর আওতায় সুবিধা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সর্বোচ্চ এক বছর ঋণ পরিশোধে বিরতি দেওয়া যাবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ জুনে বসুন্ধরার আবেদন অনুমোদন করে। কিন্তু নীতিমালায় দুই বছর ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার সুযোগ না থাকায় ৩০ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন চায় ন্যাশনাল ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমতি দেবে না, এমন নীতি নিয়েছিল। ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকের আবেদনটি চাপা পড়ে যায়। সূত্র জানায়, জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সেই নীতি থেকে সরে এসে বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিলে অনুমতি দেন।
৩১ জুলাই ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ২০২২ সালের নীতিমালার সর্বোচ্চ এক বছরের ঋণ পরিশোধে ছাড়ের শর্ত ছাড়া অন্য শর্তগুলো পালন করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিজ বিবেচনায় দুই বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই চিঠির ভিত্তিতে গ্রুপটিকে ঋণ পরিশোধে ছাড়ের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ন্যাশনাল ব্যাংক।
বসুন্ধরা গ্রুপকে দেওয়া সুবিধা সম্পর্কে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুল আলম খান বলেন, ‘তারল্য সংকটের কারণে আগের দুই বছরের সুবিধা বাতিল করে এক বছর করা হয়েছে। ঋণের সুদ প্রতি মাসে পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয়েছে।’
দীর্ঘদিন ধরেই নানা রকম সংকটে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ঋণ আদায় করতে না পারায় ব্যাংকের তারল্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম অনেকটা থমকে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকায় চেক নিষ্পত্তিও বন্ধ রয়েছে। অনেক শাখা ব্যবস্থাপক কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছেন। গত জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৪২ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৯ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০ আগস্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। নতুন পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু।
No comments