নির্মম হত্যার শিকার শামীম মোল্লার সঙ্গে জাবির নিরাপত্তা কার্যালয়ে সেদিন কী ঘটেছিল

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে কয়েক দফা মারধরের একপর্যায়ে তিনি পানি খেতে চেয়েছিলেন। তবে তাকে মারধরকারীরা পানি খেতে দেয়নি। নিরাপত্তা কর্মকর্তা পানির বোতল দিতে গেলে তার হাত থেকে বোতল ফেলে দেওয়া হয়। 

গত বুধবার বিকেলে শামীম মোল্লাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা গেটে (প্রান্তিক গেট) পিটানোর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তার অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরও কয়েক দফা মারধর করে শামীমকে রাত ৮টার কিছু পরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রাত ৯টায় শামীম সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হাসপাতালের চিকিৎসক সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, হাসপাতালে তাঁকে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল। 

শামীম মোল্লাকে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ৮ জন শিক্ষার্থী ও অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে; আটজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কেউ এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। 

আজকের পত্রিকার হাতে আসা ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা যায়, প্রান্তিক গেটে লাঠি হাতে তাঁকে মেরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব। এসময় লাথি দিতে দেখা যায় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিককে। আহসান লাবিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম একজন সমন্বয়ক। গতকাল তাঁকে এ পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি যখন সবাইকে আটকাতে যাব, তখন আমাকে আহসান লাবিব আটকে রাখে। শামীম যখন পানি খেতে চায়, তখন আমি তাকে পানি দিতে গেলে আমার হাত থেকে পানির বোতল ফেলে দেওয়া হয়।’ 

এর আগে ফেসবুকে আহসান লাবিব গতকাল একটি পোস্ট করেন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। তবে সেই পোস্ট পরে তিনি সরিয়ে নেন। সেখানেও সুদীপ্ত শাহীন মন্তব্যের ঘরে লেখেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ, শামীমকে তার শেষ চাওয়া পানিটুকু দিতে দেয়নি এই ছেলে। সে যে ধমক আমাকে দিছে গতকাল তা আমার চাকরি জীবনে কেউ দেয়নি। বেশি না আমি তার ২৩ ব্যাচ সিনিয়র।’ 

সুদীপ্ত শাহীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ওখানে যখন আমি যাই, তখন ওকে বেধড়ক মারধর করা হয়। ওদিকে মার হচ্ছে আর বীভৎস চিৎকার। এদিকে সবাই প্রক্টর রুমে বসে চিৎকার শুনতেছে; তারা বের হচ্ছে না। শামীম মোল্লাকে পানিও খেতে দেয়নি পাষণ্ডরাশামীম মোল্লাকে পানিও খেতে দেয়নি পাষণ্ডরা। 

তিনি প্রক্টরকে বলেছিলেন, ‘ছেলেটা মরে যাবে। সে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে’। তখন প্রক্টর তাকে বলেন, ‘ছেলেপেলে তাকে এখানে থেকে নিয়ে গেছে’। তখন শাহীন বলেন, ‘তাকে প্রক্টর রুমে রাখতে হবে। নিরাপত্তা কর্মকর্তার রুমেও না।’ 

নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, শামীমকে নিরাপত্তা কর্মকর্তার কক্ষের সামনে বেশ প্রশস্ত একটা খালি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর সামনেই কলাপসিবল গেট। শামীম প্রক্টরের কক্ষে থাকলে মারধর হয়তো কিছুটা কম হত। কিন্তু প্রক্টরের কক্ষের বাইরে নেওয়ায় ব্যাপক পিটুনির সুযোগ মিলে। তাকে বড় ডাল, গজার গাছের লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়।

সুদীপ্ত শাহীন বলেন, শামীমকে সহকারী রেজিষ্টার (প্রক্টর অফিস) সোহেল এর কক্ষে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে ছাত্ররা তাকে তুলে নিয়ে চলে এসেছে। তাকে প্রথম দফা মারধর করা হয় প্রান্তিকে। এরপর দ্বিতীয় দফা মারধর করা হয় ওই কক্ষ থেকে বের করে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার কক্ষের সামনে । তখন আহসান লাবিব তাকে বের করে নিয়ে চলে যায়। 

প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্র জানায়, ঘটনার সময় সুদীপ্ত শাহীন যখন প্রক্টরের কক্ষ থেকে উঠে বের হতে চান তখন লাবিব তাকে বলেন, ‘এই মিয়া আপনি কই যান, বেশি বাড়িয়েন না। আমরা আছি বলেই চাকরি করতে পারছেন। না হলে আপনিও মামলার আসামি হতেন।’ এরপর লাবিব সেখান থেকে চলে গেলে সুদীপ্ত শাহীন প্রক্টরকে কিছু করার কথা তাগাদা দেন। তখন প্রক্টর বলেন, ‘যেহেতু মব (অনেক মানুষ) বা ছেলেপেলে যা চায় এখন আর কি করবা।’ এসময় তাকে তৃতীয় দফা মারা হয়। 

সুদীপ্ত শাহীন বলেন, ‘এরপর শামীমকে ওই জায়গায় রেখে তালা মেরে রাখা হয়। এসময় লাবিব ভবনের নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে ঘুষি মারতে থাকে। তখন প্রক্টর স্যার সামনেই ছিল। গার্ডের পকেট থেকে চাবি নিয়ে তালা খুলে আরেক দফা পিটায় নিল।’ 

কেন এত দফায় তাকে মারা হল এমন প্রশ্নে শাহীন বলেন, ‘যে শুনছে, সেই শামীম মোল্লাকে মারার জন্য আসছে।’

নিরাপত্তা শাখার কার্যালয়ের ভিডিও ফুটেজ থেকে আরও পাঁচজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন— সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া, রাজু আহমেদ, রাজন হাসান, হামিদুল্লাহ সালমান এবং এম এন সোহাগ। সবাই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া ৩৩ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া রাজু আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও রাজন হাসান একই বিভাগের ৪৬ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, হামিদুল্লাহ সালমান ইংরেজি ৪৯ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও এম এন সোহাগ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। 

বারবার কেন লাবিবের কথা বলা হচ্ছে এমন প্রশ্নে শাহীন বলেন, ‘তিনি জাহাঙ্গীরনগরে চাকরিতে এসে ছাত্রদল পাননি। তাই তাদের কাউকেই ওইভাবে চেনেন না। তবে লাবিবের সঙ্গে যেহেতু একবার কথাকাটাকাটি হয়েছে, সেহেতু তিনি লাবিবকে নোটিশ করেছিলেন।’ শাহীন বলেন, ‘লাবিব প্রান্তিক গেট থেকে সাঈদ হোসেন ভূঁইয়াকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসে।’

পানি খাওয়ার বিষয়ে শাহীন বলেন, ‘যখন শেষবার মারধরের সময় শামীম পানি খেতে চেয়েছিল তখন আমি বলেছিলাম তাকে একবারে অনেক পানি দিলে সমস্যা হবে। একটা হাফ লিটার ঠান্ডা পানির বোতল থেকে অল্প অল্প করে দিতে হবে। তখন শামীমকে পানির বোতল দিতে গেলে লাবিব সেটি আমার হাত থেকে নিয়ে ফেলে দেয়।’

প্রান্তিক গেট থেকে মারধরের পর যখন শামীম মোল্লাকে নিরাপত্তা অফিসের এখানে আনা হয় তখন সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া সেখানে ছিলেন। ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আজকের পত্রিকাকে বলেন, সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া উপাচার্যের সঙ্গেও দেখা করেন তখন। ‘শামীমকে মেরে ক্লান্ত’ এ কথা উপাচার্যকে জানান সাঈদ হোসেন। উপাচার্যের কক্ষে থাকা পানির গ্লাস থেকে পানিও খান। সে সময় সেখানে সাংবাদিকসহ অন্যান্যরাও ছিলো।

শামীম মোল্লার ডেথ সার্টিফিকেটে একটা কপি রয়েছে, সেখানে দেখা গেছে শামীম মোল্লা রাত ৯টায় মারা যান। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়নি। সরাসরি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। 

সুদীপ্ত শাহীন বলেন, শামীম মোল্লা শুধু একবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছিল। তখন তাকে ধরে গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতে উঠেই সে সিটের ওপর পড়ে যায়। গাড়িতে ওঠানোর সময়েও তাকে মারধর করা হচ্ছিল। রাত সাড়ে ৮টায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হয়। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যেতে সময় লাগবে আর কত। ৯টার পরেই তার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। এখানে থানা বা অন্য কোথাও তাকে নেওয়ায় সুযোগ ছিল না। 

আশুলিয়া থানা সূত্রে জানা যায়, ওই দিন দুই পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে শামীম মোল্লা পুলিশের গাড়িতে ওঠেন। তখনও পেছন থেকে তাকে  ধাক্কা ও কিল ঘুষি মারা হচ্ছিল; গাড়িতে উঠেই তিনি পড়ে যান। তখন পুলিশ ধারণ করেছে, গাড়িতেই শামীম হয়তো মারা যাবে। পুলিশের গাড়ি সরাসরি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যায়। শামীম মোল্লা গাড়িতে থাকা পুলিশের কাঁধে এলিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার পালস পাওয়া যায়নি। এরপর ইসিজি করা হয়। 

এই বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রান্তিক গেট থেকে শামীম মোল্লাকে নিয়ে আসার পরে আমরা তাঁকে নিরাপত্তা অফিসে কলাপসিবল গেটে তালা মেরে আটকে রাখি ৷ এসময় কলাপসিবল গেট ভেঙে কিছু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে মারধর শুরু করে। এ ঘটনা দেখে আমি এবং আমার টিম দৌড়ে যাই এবং সেখানে শিক্ষার্থীদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াই। এতে কিছু শিক্ষার্থী নিবৃত্ত হয়। তখন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কি করছিলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এক পর্যায়ে তাঁরাও ব্যর্থ হয়।’

প্রক্টরের উপস্থিতিতে এরকম পিটুনি ঠেকানো গেল না কেন, তাকে তৃতীয় দফা মারা হয় এবং সেক্ষেত্রে কোনো অবহেলা আছে কিনা তা— এমন প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, ‘আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলেছি, আমার সামনে তোমরা এটা করতে পার না। এমনকি আমি তাদের সামনে ঢাল হয়েও দাঁড়িয়েছি। এতে কিছু শিক্ষার্থী আমার কথা শুনলেও অনেকে না শুনে মারধর করেছে। আমাদের কয়েকজনের পক্ষে এতজন শিক্ষার্থীকে আটকানো সম্ভব ছিল না।’