গণঅভ্যুত্থানের ১ মাস । আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস হলো আজ। শেখ হাসিনাকে হটিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের যে স্বপ্নে ছাত্র-জনতা আত্মোৎসর্গ করেছেন, তা পূরণের অগ্রগতি এখনও দৃশ্যমান নয়।
বরং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশি মনোযোগী হতে হচ্ছে। অভ্যুত্থানে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা। গণহত্যায় দায়ীদের বেশির ভাগ অধরা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সরকারকে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দাবি-দাওয়া থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
সরকার হটানোর মাস পূর্তিতে অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণে ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচি পালন করা হবে আজ বৃহস্পতিবার। গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও আবু বাকের মজুমদার।
ফিরে দেখা
হাইকোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে গত ১ জুলাই রাস্তায় নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ‘রাজাকারের সন্তান’ আখ্যা দিলে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলতে শুরু করেন– ‘আমি কে, তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীরা সীমা লঙ্ঘন করেছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৫ জুলাই দুপুরে বলেন, এর জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত।
এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের নিয়ে শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। সেই দিনের রক্তাক্ত হামলার ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। বিনা উস্কানিতে গুলি করে পুলিশ। এ নৃশংসতার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। সেদিন নিহত হন ছয়জন।
১৭ জুলাই শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে এসব হত্যার বিচারের প্রতিশ্রুতি দিলেও তাতে সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া ক্ষোভের প্রশমন হয়নি। ১৮ জুলাই পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও বিস্ফোরণ্মুখ। শিক্ষার্থীর সঙ্গে রাস্তায় নামে লাখো জনতা। এতে নির্বিচার গুলি চালায় পুলিশ। আন্দোলন থেকে রূপ নেয় গণবিক্ষোভে।
ভোটাধিকার, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করা এবং আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ক্ষমতার নির্বিচার অপব্যবহার এবং দম্ভের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা সোচ্চার হয়। তবে আওয়ামী লীগ পুরোনো কৌশল অনুযায়ী, অভ্যুত্থানকে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা আখ্যা দিয়ে মামলা ও গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে দমনের চেষ্টা করে।
১৮ থেক ২১ জুলাই চার দিনে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মোহাম্মদপুরে দুই শতাধিক বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে পুলিশসহ সরকারের অন্যান্য বাহিনী। ইন্টারনেট বন্ধ করে, টেলিভিশনের খবরে মৃত্যুর সংবাদ প্রচারে বাধা দিয়েও হাসিনা সরকার আন্দোলন দমাতে পারেনি। মুদ্রিত সংবাদপত্রে বর্বর হত্যাযজ্ঞ উঠে আসে।
গণহত্যা চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পরিস্থিতি কিছুটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় ২৪ জুলাই। পরের দিন শেখ হাসিনা হতাহতদের দেখতে না গিয়ে পরিদর্শনে যান দুর্বৃত্তের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেলের স্টেশন। এর দু’দিন পর তিনি হতাহতদের দেখতে যান। ততদিনে জনরোষ পৌঁছে চরমে। সেই সময়ে আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তার নামে ডিবি অফিসে আটকে রেখে নানা ‘নাটক’ মঞ্চস্থ করা হয়। এচ
ছাত্ররা এতে দমে না গিয়ে বহু গুণ সমর্থন নিয়ে বিক্ষোভে নামেন। ১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ ছিল আন্দোলনে। তবে জুলাইয়ের শেষ দিকে শিক্ষার্থীর মা-বাবা থেকে শুরু করে শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ নেমে আসেন। বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা রাজপথে নামেন।
এ পরিস্থিতিতেও শেখ হাসিনা পুলিশ এবং দলীয় সশস্ত্র নেতাকর্মীকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেন। তাঁকে হটাতে ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক দফা ঘোষণা করে। সেই রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ায় আওয়ামী লীগ। পরদিন দলটির নেতাকর্মীরা পুলিশের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে মাঠে নেমেও আন্দোলন দমন করতে পারেনি। উল্টো ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সেদিন অন্তত ৭০ আন্দোলনকারীসহ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ৫ আগস্ট সকালেও ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। বেলা ১১টা থেকে পরবর্তী এক ঘণ্টা যাত্রাবাড়ী, চানখাঁরপুর ও উত্তরায় গণহত্যা চালায় পুলিশ সদস্যরা। সেসব ঘটনাস্থলে ৭৬ বিক্ষোভকারী নিহত হন। তবে ১২টার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সেনাবাহিনী বিভিন্ন সড়ক থেকে সরে আসে। শেখ হাসিনার পতনের লক্ষণে লাখ লাখ মানুষ নেমে আসেন সড়কে। ছাত্র-জনতা গণভবন অভিমুখে আসছে খবরে হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। অবসান ঘটে স্বৈরশাসনের।
সংস্কার দৃশ্যমান নয়
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র সংস্কার দাবিতে হয়েছিল অভ্যুত্থান। তবে সংস্কারের চেয়ে ইউনূস সরকারকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। হাসিনা আমলের প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের সরাতে ঢালাও পদোন্নতি এবং পদায়ন করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ আমলে কোণঠাসা থাকা পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের। এতে দুর্নীতিসহ নানা অকর্মে শাস্তি পাওয়া কর্মকর্তারাও পুরস্কৃত হচ্ছেন।
বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়, কর্ম কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার শুরু হয়নি। মানবাধিকার কমিশন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা জরুরি।
বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত সংস্কার প্রক্রিয়া চায়। তবে সরকার এখনও জানায়নি কীভাবে এবং কবে নাগাদ সংস্কার শেষ হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গতকাল সচিবদের উদ্দেশে বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ গড়তে গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে চিন্তার সংস্কার করে, সৃজনশীল উপায়ে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ‘মার্চিং অর্ডার’ দিয়েছেন তিনি।
নিহত অজানা, দায়ীদের বেশির ভাগ অধরা
গণহত্যায় দায়ী শেখ হাসিনাসহ অধিকাংশ ব্যক্তিকে এখনও আইনের আওতায় আনা যায়নি। শতাধিক হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে রয়েছেন। ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাদের অবস্থান অজানা।
আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলির ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে অন্যতম দায়ী মনে করা হয়। অর্ধশত মামলা হলেও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসিনা আমলের পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনক সেনা হেফাজত থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সেই সময়কার ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ বিতর্কিত এবং অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের পাওয়া যায়নি।
বেসরকারি একটি সংস্থার হিসেবে অভ্যুত্থানের সময় সহিংসতায় অন্তত ৮২১ জন প্রাণ হারান। সমকালের হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ৭০০। সরকারপ্রধান জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে হতাহতের প্রকৃত হিসাব এবং গণহত্যার শিকার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। তবে কবে নাগাদ এ কাজ হবে, তা নিশ্চিত নয়।
আইনশৃঙ্খলা আসেনি নিয়ন্ত্রণে
নতুন সরকার ৯ আগস্ট দায়িত্ব নিলেও এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। জনরোষের মুখে ৫ আগস্ট পুলিশ পালিয়ে যাওয়ায় থানাগুলো থেকে অস্ত্র-গুলি লুট হয়। এখনও সোয়া ২ হাজারের বেশি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। বিভিন্ন থানায় নেই প্রয়োজনীয় জনবল ও গাড়ি। এখনও পলাতক আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অনেক পুলিশ সদস্য। যারা সরকারি চাকরিবিধি না মেনে রাজনীতিকের মতো আচরণ করতেন। এ পরিস্থিতিতে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা পদোন্নতি, বেতন বাড়ানো, চাকরি স্থায়ীকরণসহ নানা দাবিতে পরিস্থিতির অনবতি ঘটিয়েছেন। কয়েক দিন ধরে যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা দাবিতে শুরু হয়েছে শ্রমিক বিক্ষোভ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, পুলিশের ইমেজ আস্তে আস্তে ফিরছে। আমার কাছে এ রকম কোনো কিছু নাই যে, আমি এক দিনে সব উন্নতি করে ফেলব। এটা আস্তে আস্তে হবে।
জেলা-উপজেলায় যাবেন ছাত্রনেতারা
চলমান চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে জেলা ও উপজেলায় সফরের ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সমন্বয়ক আবু বাকের বলেছেন, এর মাধ্যমে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে পুনর্গঠন করা হবে। একটি চক্র চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, দখলদারি করছে। আন্দোলনকারীরা একতাবদ্ধ হয়ে এসবের বিরুদ্ধে কাজ করবে। এ ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ ও বিপ্লব রক্ষায়ও কাজ করা হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা থাকবে।
সফরের পর রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে কিনা– প্রশ্নে আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষকে করুন। তারা নতুন রাজনৈতিক দল চায় কিনা। জনগণ নির্ধারণ করবে তারা দ্বিদলীয় রাজনীতি থেকে বের হতে চায় কিনা।
সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, শহীদি মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, কলাবাগান, ধানমন্ডি, সংসদ ভবন, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ হবে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা নিজ জায়গা থেকে শহীদি মার্চে অংশ নেবে। জেলা-উপজেলায়ও শিক্ষার্থীদের শহীদি মার্চ হবে।
No comments