‘তবলা বাদক থেকে মিডিয়া মাফিয়া’ তাপসের যত অপকর্ম
ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন তবলা বাদক। একটা পর্যায়ে বনে গেলেন টিভি চ্যানেলের কর্ণধার। কখনও গায়ক, কখনও সুরকার, আবার কখনও সংগীত পরিচালক। এক কথায় গানের জগতটাকে কুক্ষিগত করে একাধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিলেন মিডিয়ার সর্বত্র। কৌশিক হোসেন তাপসের এমন উত্থান তাক লাগাতে বাধ্য যে কাউকে। সম্প্রতি একটি মামলায় কারাগারে আছেন বাংলাদেশের মিডিয়ার রহস্যময় এ চরিত্র।
এর আগে গত রোববার রাতে রাজধানীর ভাটারার প্রগতি সরণি থেকে তাপসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উত্তরা পূর্ব থানায় দায়ের হওয়া এক মামলার ৯ নম্বর আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থের যোগান দিয়েছেন তিনি।
কারাগারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘গান বাংলা’ চ্যানেলের আড়ালে তাপসের অপকর্মের বিশাল এক ফিরিস্তি সামনে উঠে এসেছে, যেসব নিয়ে এতদিন প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস হয়নি কারও। গানবাংলায় যাতায়াত আছে এমন কয়েকজনের বক্তব্য, টিভি চ্যানেলটির অফিসে মাঝেমধ্যেই দেখা মিলত তারকাদের। চলত রাতভর আড্ডা, গান। এসবের মধ্যমণি ছিলেন তাপস ও তার স্ত্রী ফারজানা মুন্নী। অনেকে বলেন, স্ত্রীর হাত ধরেই রাতারাতি উত্থান ঘটেছিল তাপসের। স্ত্রীকে ব্যবহার করেই আওয়ামী সংস্কৃতি অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তাপস। একসময় সম্পৃক্ত হন রাজনীতিতেও। বিভিন্ন অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাপসের বিরুদ্ধে। গানের অনুষ্ঠানের নামে তিনি ওই সব কুকীর্তি করতেন বলে জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পেশাজীবনের শুরুতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মচারী ছিলেন তাপস। গানবাংলা চ্যানেলের মালিক ছিলেন রবি শংকর মৈত্র। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তার কাছ থেকে চ্যানেলটি নিয়ন্ত্রণে নেন তাপস। এরপর থেকে দেশের সংগীতাঙ্গনকে যেভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন তিনি, তা নজিরবিহীন। তার দখল করা ‘গান বাংলা চ্যানেলে’ গানের আড়ালে চলত রঙ্গলীলা। দেশি-বিদেশি অভিনেত্রী-শিল্পীদের ব্যবহার করা হতো প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী ও আমলাদের মনোরঞ্জনের জন্য। বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগী নারীরা এসব বিষয়ে তাপসের বিরুদ্ধে যথাযথ স্থানে অভিযোগও করেছিলেন। কিন্তু ওপরের মহলের বিশেষ আশীর্বাদে গান বাংলার তাপস সব সময়ই ছিলেন অধরা।
তাপসের উত্থানের গল্প:
২০০৬-০৭ সালের দিকে একটি টেলিভিশনে প্রোগ্রামের আয়োজন করেন তাপস। এর মাধ্যমে মিডিয়াতে কাজ শুরু করেন তিনি। যাতায়াত বাড়তে থাকে মিডিয়া অঙ্গন ও বিভিন্ন সংগঠনে। এরই মাঝে একসময় তার পরিচয় হয় মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা করা এক ব্যক্তির স্ত্রী ফারজানা মুন্নির সঙ্গে। মিডিয়া অঙ্গনে তার পরিচিতি রূপচর্চা ও ফ্যাশন এক্সপার্ট হিসেবে। ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। পরিচয় দিতেন সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের ভাতিজি বলে। তাপসের কথায় ও গিটারের সুরে মুগ্ধ হন মুন্নি। আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে বিয়ে করেন তাপসকে।
জানা যায়, পরবর্তীতে লোটাস কামালের প্রভাব খাটিয়েই মিডিয়া অঙ্গনে নিজেকে মাফিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তাপস। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবৃত্তিশিল্পী রবিশঙ্কর মৈত্রীর গান বাংলা চ্যানেলটি দখল করেন তাপস। রবিশঙ্করকে হুমকি দেন সপরিবারে প্রাণনাশের। সেই ভয়ে পরিবার নিয়ে দেশ ত্যাগ করেন রবিশঙ্কর। এরপরও শাস্তি পেতে হয় তাকে। ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল তাপস প্রভাব খাটিয়ে রবিশঙ্করের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এই নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বরাবর খোলা চিঠিও দিয়েছেন রবিশঙ্কর। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। দখল করা গান বাংলার মাধ্যমে মিডিয়া জগতে ‘মাফিয়াগিরি’ শুরু হয় তাপসের।
শেখ হাসিনার বিউটিশিয়ান হিসেবে পরিচিত ছিলেন তাপসের স্ত্রী মুন্নি। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল মুন্নির। স্ত্রীর হাত ধরে আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক অনুষ্ঠানে যাতায়াত শুরু করেন তাপস।
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের আমলের সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন মিডিয়া মাফিয়া তাপস। এই সুবাদে একক নিয়ন্ত্রণে নেন মুজিববর্ষের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আয়োজিত লাল-সবুজের মহোৎসব ও ২০২২ সালে চট্টগ্রাম-বরিশালে ‘জয়বাংলা উৎসব’ নামে একাধিক কনসার্ট করেন তাপস। বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকারা এসব অনুষ্ঠানে পারফরম করতেন। সেখানে অতিথি হিসেবে থাকতেন সালমান এফ রহমান, স্থানীয় মেয়র ও প্রভাবশালী নেতারা। কনসার্টে অংশ নেওয়া শিল্পীদের বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশ নিজের পকেটে পুরতেন তাপস। এভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তাপস।
রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরিচিতির সুবাদে প্রভাব খাটিয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পও বিভিন্ন কায়দায় বাগিয়ে নিতেন তাপস। এক্ষেত্রে তার আকর্ষণীয় হাতিয়ার ছিল নারী। মূলত, নারী সাপ্লাই দিয়ে সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের সচিবদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন তাপস-মুন্নি দম্পতি।
গান বাংলায় কাজ করা অনেকেই জানিয়েছেন, নাইটক্লাবের মতো রাত যত গভীর হতো, তাপসের গান বাংলা টেলিভিশন তত বেশি জমজমাট হয়ে উঠত। মধ্যরাতে অফিসে প্রবেশ করতেন তাপস ও মুন্নি। রাত গভীর হলেই গান বাংলার অফিসে উঠতি বয়সী গায়িকা এবং দেশের খ্যাতনামা অভিনেত্রীদের আনাগোনা বাড়ত। উঠতি বহু গায়িকা ছিল তাপসের হাতে বন্দি। তাপসের ইশারায় প্রভাবশালী নেতা ও আমলাদের মনোরঞ্জন করতে হতো এই শিল্পীদের। বিনিময়ে তাদেরকে নিজের টেলিভিশনে ও কনসার্টে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিতেন তাপস। দেশের বিখ্যাত গানগুলো বিকৃত করেছেন সেসব গায়িকারা।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিদেশি শিল্পীদের দেশে আনার পেছনে বড় একটা উদ্দেশ্য ছিল তাপস-মুন্নির। তাদের আনা-নেওয়ার মাধ্যমে প্রভাবশালীদের মোটা অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করতেন এই দম্পতি।
তাপসের সঙ্গে দেশের আর্থিক খাতের মাফিয়া সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বেশ সুসম্পর্ক ছিল। সেই খুঁটির জোরে প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের অপকর্ম চালিয়ে গেছেন তাপস। ২০২২ সালে নিজের মেয়ের বিয়েতে নাচাতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞাকে তুচ্ছ করে ঢাকায় আনেন সাবেক পর্নো তারকা সানি লিওনকে। এতে পরোক্ষ সহযোগিতা করেন প্রভাবশালী সালমান এফ রহমান। কলকাতার নুসরাত জাহান, মিমি চক্রবর্তীসহ অনেকে তার মেয়ের বিয়েতে যোগ দেন। বলিউড নায়িকা নার্গিস ফাখরিও তার হাত ধরে ঢাকায় এসেছিলেন। এসবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জন করা।
বিদেশ থেকে নারী অভিনেত্রী ও শিল্পীদের দেশে এনে গানের আড়ালে প্রভাশালীদের মনোরঞ্জনের কাজে লাগাতেন তাপস। বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশি শিল্পীরা যাতে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারেন সে লক্ষ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও শেখ হাসিনার সাবেক উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসের খুরশিদ আলমের সঙ্গে। কর ফাঁকি দিয়ে গান বাংলার নাম করে ইউক্রেন-রাশিয়া-ইন্ডিয়া-দুবাই থেকে নারী এনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনে পাঠাতেন তিনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একাধিকবার বিদেশি কয়েকজন নারীকে আটকে দিয়েছিল পুলিশ। তখন শাহরিয়ার ও খোকনকে ফোন করে তাদের ছাড়িয়ে নেন তাপস।
সুযোগসন্ধানী তাপস সময়মতো তার ভেলকি দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারকেও। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফল অনুমান করে সরকার পতনের ঠিক চার দিন আগে খোলস পাল্টে ফেলেন তিনি। নিজের ফেসবুক পেজের প্রোফাইল ও কাভার পিকচার লাল করে একাত্মতা প্রকাশ করেন ছাত্রদের সঙ্গে। কিন্তু এরপরও শেষ রক্ষা হলোনা তাপসের। সোমবার (৪ নভেম্বর) তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আগামীকাল বুধবার (৬ নভেম্বর) হবে তার রিমান্ডের শুনানি।
No comments