চক্ষু চিকিৎসক থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসক
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এসেছে, তবে একটি গাড়ি দুর্ঘটনাই সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক। বাবার হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য তাকে তৈরি করা হয়নি। ক্ষমতার পথে আসাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার বড় ভাই বাসেলের গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর। ১৯৯৪ সালে দামেস্কের কাছে ওই দুর্ঘটনা যখন ঘটে, আসাদ তখন লন্ডনে চক্ষু চিকিৎসা নিয়ে পড়ছিলেন। বাসেলের মৃত্যুর পর আসাদকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা শুরু হয়। পরে তিনিই দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, যে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অনেকে।
আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ প্রায় ৩০ বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৬৫ সালে বাশার আল-আসাদের জন্মের সময়টাতেও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল। অন্য আরব দেশের মতো সিরিয়াতেও গণতন্ত্র ছিল না ও বহুদলীয় নির্বাচন হতো না। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সেখানকার সব দেশেই আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল।
আসাদের পরিবার যে সম্প্রদায়ের ছিলেন তারা ছিলেন সিরিয়ার খুবই অনগ্রসর একটি সম্প্রদায়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের অনেক সদস্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।
হাফিজ আল-আসাদ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে উঠে আসেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাথ পার্টির সরকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। পরে দেশের প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭১ সালে। এরপর ২০০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ওই পদেই বহাল ছিলেন। তার সময়ে অনেক সামরিক অভ্যুত্থান হলেও তা সফল হয়নি। বরং বিরোধীদের দমন ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তিনি কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছেন।
মেডিসিন ও লন্ডন
রাজনীতি ও সামরিক বাহিনী থেকে দূরে থাকতে বাশার আল-আসাদ ডাক্তার হিসেবেই তার ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষে তিনি ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যে যান লন্ডনের ওয়েস্টার্ন আই হসপিটালে চোখের ডাক্তার হিসেবে পড়ালেখার জন্য। এ সময় তিনি ইংরেজ গায়ক ফিল কলিন্সের অনুরক্ত হন ও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হন। লন্ডনেই আসমা আল-আখরাসের সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তী সময়ে তারা বিয়ে করেন। আসমা কিংস কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তেন। তিনি হার্ভার্ডে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু বাশার আল-আসাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে যায় বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওই মৃত্যুই মূলত বাশার আল-আসাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ তাকে ফিরে যেতে হয় সিরিয়ায় এবং এরপর তাকে সিরিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়। বাশার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং ভবিষ্যতের জন্য জনগণের সামনে নিজের ইমেজ তৈরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
পরিবর্তনের স্বপ্ন
হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দ্রুতই প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন বাশার আল-আসাদ। তবে এ জন্য দেশটির সংবিধানে প্রেসিডেন্টের সর্বনিম্ন বয়স ৪০ বছর থাকার যে বিধান ছিল তা পরিবর্তন করতে হয়। দায়িত্ব নিয়ে তিনি ‘স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন, জবাবদিহি ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনা’র কথা বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাস পর তিনি আসমা আল-আখরাসকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান রয়েছে।
প্রথমদিকে তার রাজনৈতিক সংস্কার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক বক্তব্য অনেককে আশাবাদী করেছিল। তার নেতৃত্বের স্টাইল ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আসমার সঙ্গে জুটিবদ্ধ হওয়া- অনেককে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান চালায় ও বহু সোচ্চার কণ্ঠকে আটক করে। বাশার আল-আসাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত সংস্কার করলে ব্যক্তি খাত উৎসাহী হয়ে ওঠে। তবে আর শাসনের প্রথম দিকে উত্থান হয় তার চাচাতো ভাই রামি মাখলৌফের। তিনি সম্পদ আর ক্ষমতার সমন্বয়ে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন।
ইরাক ও লেবানন
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধকে ঘিরে বাশার আল-আসাদের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। তিনি ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। সম্ভবত তার আশঙ্কা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র সেই সময় ইরাকে তাদের বিরোধীদের কাছে অস্ত্র চোরাচালানে সহায়তার জন্য দামেস্ককে দায়ী করছিল। সে সময় ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
এরপর ২০০৫ সালে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি বৈরুতে বিস্ফোরণে নিহত হলে এ ঘটনার জন্য অনেকে সিরিয়া ও তার সহযোগীদের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। লেবাননে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হয় ও দামেস্কের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে লেবাননে থাকা সিরিয়ার ৩০ বছরের সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহার করতে হয়।
আসাদ ও তার লেবাননের সহযোগী হিজবুল্লাহ অবশ্য ওই হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। যদিও পরে বিচারে বিশেষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে হিজবুল্লাহর কয়েকজন সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়।
আরব বসন্ত
বাশার আল-আসাদের শাসনের প্রথম দশকে ইরান, কাতার এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। যদিও শুরুতে রিয়াদ তরুণ প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।
মূলত, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাশার তার বাবাকে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু শাসন শুরুর এক দশক পর কর্তৃত্ববাদের দিকে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। শুরু হয় বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন। ২০১০ সালে আসাদের স্ত্রী ভোগ ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, তাতে তার ঘরে গণতন্ত্র আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
ওই একই সময়ে তিউনিসিয়ায় একজন সবজি বিক্রেতা পুলিশের চড় খেয়ে ক্ষোভে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ হয়, সেটিই আরব বসন্তে রূপ নেয় ও একপর্যায়ে বিদায় নিতে বাধ্য হন তিউনিশিয়ার তখনকার প্রেসিডেন্ট বেন আলি।
এটিই তখন পুরো আরব অঞ্চলে, বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন এবং সিরিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনগুলোকে উৎসাহী করে তোলে। একপর্যায়ে ২০১১ সালের মার্চে দামেস্কে বিক্ষোভ দেখা যায় এবং পরে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দারারাতে দেয়ালে আসাদবিরোধী স্লোগান লেখার দায়ে শিশুদের আটক করা হলে সেখানেও আন্দোলন শুরু হয়।
দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করে আসাদ পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে সিরিয়াকে টার্গেট করে ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে একে মোকাবিলার কথা বলেছিলেন। তবে অনেক মানুষের যে মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না তাও স্বীকার করেন তিনি। এরপর নিরাপত্তা বাহিনী দারারাতে শক্তি প্রয়োগ করলে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়। অনেক শহরে আসাদের পদত্যাগের দাবি ওঠে। কর্তৃপক্ষ সহিংস পন্থায় তা দমনের চেষ্টা করে। কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে, কারণ সরকারি বাহিনী ও সশস্ত্র বিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে দেশজুড়ে সংঘর্ষ হতে শুরু করে।
No comments