পাল্টে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট
সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। এক সপ্তাহ আগেও যেটি অকল্পনীয় ছিল তা এখন সত্য। মাত্র সপ্তাহখানেকের বিদ্রোহ ঝড় বাশার আল আসাদের দীর্ঘ ২৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। ইরান-সমর্থিত আসাদ সরকারের পতন নিশ্চয়ই মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কিছু পরবর্তন আনবে।
বাশার আল আসাদের পতন সিরিয়ার ইতিহাসে এক বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে লেখা থাকবে। কারণ বাশারের বাবা হাফিজ আল আসাদ তার ২৯ বছরের শাসনামলে দমন ও নিপীড়ণমূলক রাজনীতির জন্য খ্যাত ছিলেন। তার শাসনামলে বিরোধী মতের কোনো জায়গা ছিল না। বাশার এসব স্বৈরাচারী মনোভাব বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। প্রথমদিকে বাবার তুলনায় উদার, কম হিংস্র মনে করা হলেও সেই ধারণা অল্প দিনেই ভুল প্রমাণিত হয়। দেখা গেল বাশারের সহ্যসীমা ক্ষেত্রবিশেষে বাবার চেয়েও অনেক কম। ২০১১ সালের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করতে করতে গিয়ে দেশে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী বাশার আল আসাদই।
প্রথম দফায় মিত্র ইরান, রাশিয়া এবং হিজবুল্লাহসহ বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপের সহায়তায় পার পেয়ে গেলেও এ দফায় তা আর সম্ভব হয়নি। আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের শাসনের পতন মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনছে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বলয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। ইরান-সমর্থিত সবচেয়ে বড় লেবাননের মিলিশিয়া হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহের সবচেয়ে বড় রাস্তা ছিল সিরিয়া। বাশারের পূর্ণ সমর্থন থাকায় মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সঙ্গে সিরিয়া দিয়ে অবাধে যোগাযোগ করত ইরান। বাশারের পতনে সেই যোগাযোগে ব্যাপক বেগ পেতে হবে ইরানকে। এমনিতেই ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় হিজবুল্লাহর পরিস্থিতি বেশ নাজুক, এখন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
ইরানের এই সংকট নিশ্চিতভাবে ইসরায়েলের বড় উদযাপনের কারণ হবে। অনেকে বিশ্বাস করেন, সিরিয়ার এত বড় পরিবর্তন তুরস্কের আশীর্বাদ ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। তুরস্ক ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের নানাভাবে সমর্থন দিয়ে এলেও এবার হায়াত তাহরীর আল-শামসের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে তারা। তবে প্রায়য়ই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বাশারকে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানে আসার জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন, যাতে সিরিয়ার ৬০ লাখের বেশি শরণার্থী বাড়ি ফিরতে পারে। শরণার্থীদের ৩০ লাখই আশ্রয় নিয়েছে তুরস্কে। এই শরণার্থী সমস্যা মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে বেশ সংবেদনশীল ইস্যু। কিন্তু বাশার বারবার এরদোয়ানের এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু পরে কী হতে যাচ্ছে? তাহরির আল-শামসের উত্থানের সঙ্গে আল-কায়েদার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং তাদের একটি হিংস্র অতীতও রয়েছে। যদিও বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ, তারা এখন সব বিষয়ে উদারপন্থি নীতি অবলম্বন করছে। শেষ কয়েক বছরে তারা নিজেদের একটি জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করেছে। এ ছাড়া তাদের সাম্প্রতিক আচরণে কূটনৈতিক এবং সমঝোতামূলক সুর রয়েছে। তবে সব অংশীজনরা এই বিষয়ে আশ্বস্ত নন। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতায় এলে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত। বিশেষত কুর্দি, শিয়া এবং খ্রিষ্টানরা।
তুরস্ক-সমর্থিত অপর বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) কুর্দিদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, সেটাই এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। বিদ্রোহী দলগুলো আলেপ্পো ও এর গ্রামাঞ্চল দখলের ফলে কয়েক হাজার সিরিয়ান কুর্দি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এসব অঞ্চলে এক লাখের বেশি কুর্দি বাস করে। ২০১৬ সাল সিরিয়ার একটি এলাকা কুর্দিদের দখলে এলে ওই এলাকার অনেক সিরিয়ান আরবকে তুর্কি-নিয়ন্ত্রিত আজাজে পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করা হয়েছিল। ফলে কুর্দিদের প্রতি তাহরিরের আশ্বাসে কতটা ভরসা রাখা যায়, তা বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে উপসাগরীয় দেশগুলো বিদ্রোহের প্রথমদিকে আসাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও সম্প্রতি দেশগুলো বিশেষত সৌদি আরব ও আরব আমিরাত এবার আসাদের পক্ষে ছিলেন। তাই বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন হয় সেটিও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি বড় প্রভাব রাখবে। সূত্র: বিবিসি, মিডল ইস্ট আই
No comments