কী হবে দেশের বাইরে ৬০ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তুর ?
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০১১ সালে। মাঝে কয়েক বছর যুদ্ধ বন্ধ ছিল। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি। যুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লাখ। দেশে এবং দেশের বাইরে মিলিয়ে তাদের অর্ধেকের বেশি যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার সহিংস পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে দেশটির অধিকাংশ নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ জর্ডান, লেবানন ও তুরস্কে। এদের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এদের মধ্যে ৬ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে জর্ডানে। এ ছাড়া সিরিয়ার অভ্যন্তরেই ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মতে, গত কয়েক দশকে এটিই সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট।
শুরুটা হয়েছিল নিজ দেশের শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের, বিশেষত বেকার তরুণদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ থেকে। তারুণ্যের সেই প্রতিবাদ দমাতে খড়্গহস্তা হন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। রক্ত ঝরে রাজপথে। অশান্তি ও সংঘাত ছড়ায় দেশজুড়ে। সেই শুরু, এরপর দেশটির সংঘাত রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। এতে একে একে জড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক শক্তি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পরাশক্তিরা। প্রাণ যায় কয়েক লাখ মানুষের। দেখা দেয় ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের।
এক সময়ের সমৃদ্ধ দেশটি এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ। ২০১১ সালের মধ্য মার্চে দেশটিতে যে সংকটের সূচনা হয়, তার আজও সমাধান হয়নি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১৩ বছর। দেশটিতে শান্তি ফেরেনি। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ও যুদ্ধ নিয়ে যখন বিশ্ববাসী সরব এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছে তখন অনেকটাই চাপা পড়ে যায় বিষয়টি।
জাতিসংঘ বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় ১ কোটি ৪৬ লাখের বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ চরম সংকটে ভুগছিল। দেশটিতে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পায় না। প্রায় ৫ লাখ সিরীয় শিশু ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় ১৯৭১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন শাসক হাফেজ আল-আসাদ। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়। তখন পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এরপর ওই বছরের ১৭ জুলাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তার ছেলে বাশার আল-আসাদ। ২৪ বছর পরও তিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। বাশার আল-আসাদের ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই সিরিয়ার তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাক্স্বাধীনতার অভাববোধ থেকে তুমুল হতাশা ছিল, যা উসকে দেয় আরব বসন্ত।
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার দক্ষিণের শহর দেরাতে প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে তার আগে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছোট ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভ দমিয়ে গদি টিকিয়ে রাখতে সরকারি বাহিনীকে মাঠে নামান বাশার আল-আসাদ। দমন-পীড়নের মুখে বিক্ষোভকারীরা বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ দাবি তোলেন। ফলে বেড়ে যায় সরকারি দমন-পীড়নের মাত্রা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিরিয়ায়। সিরিয়ায় বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায় ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। এ দিনকেই সিরিয়ায় গণ-আন্দোলনের শুরুর দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
একপর্যায়ে বাশার আল-আসাদের বিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তাদের ‘বিদেশি শক্তির মদদে পরিচালিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার। চলে চরম দমন-পীড়ন। তবে খুব একটা লাভ হয়নি। সিরিয়াজুড়ে শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। একের পর এক এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এ পরিস্থিতির সুযোগ নেয় বিদেশি শক্তি-পরাশক্তিরা। কেউ কেউ বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়ায়। তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কেউবা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে উত্থান হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদার। স্বশাসনের দাবি তুলে সংঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করে সিরিয়ার কুর্দিরা। তবে এগুলোর জন্য সবচেয়ে ভুক্তভোগী হতে হয় দেশটির সাধারণ মানুষকে। জানমালের ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে তাদের।
খবরে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক দশকে যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে নারী, শিশুসহ ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। এ হিসাব জাতিসংঘের। তবে সংস্থাটি বলছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাবে, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সিরিয়া যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৪ হাজার।
বাশার আল-আসাদ সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া ও ইরান। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাশার আল-আসাদের বিরোধী। তাদের সঙ্গে রয়েছে তুরস্ক, সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোর অনেকেই। ২০১৫ সালে বাশার আল-আসাদ সরকারের সমর্থনে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সিরিয়া যুদ্ধে প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া। মস্কোর দাবি, তারা সিরিয়ায় শুধু ‘সন্ত্রাসীদের’ স্থাপনায় হামলা চালায়। তবে পশ্চিমারা বলে থাকে, রুশ হামলায় সশস্ত্র বিদ্রোহী ও বেসামরিক মানুষজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
খবরে বলা হয়েছে, প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সিরিয়ার এক শহর থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। প্রায় ২০ লাখ অসহায় মানুষ বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। ন্যূনতম মৌলিক সেবা ছাড়া সেসব শিবিরে তাদের মানবেতর জীবন কাটছে। অনেকে শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। সিরীয়দের দেশ ছাড়ার এসব ঘটনাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট বলে মত বিশ্লেষকদের।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিয়ার উদ্বাস্তু সঙ্কটের সমাধান হবে কিনা। গতকাল রবিবার বিদ্রোহীরা আসাদ আল বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। এখন সেখানকার পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা স্পষ্ট নয়। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ক্ষমতা নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে শতাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তবে যারা বাস্তু হারিয়েছেন তারা নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে চান।
বিদ্রোহীরা সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী আলেপ্পোর বেশির ভাগ অংশের দখলে নেওয়ার পর এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, বেসামরিক মানুষ ও বেসামরিক অবকাঠামোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সব পক্ষকে অবশ্যই যথাসাধ্য করতে হবে। প্রায় ১৪ বছর ধরে সিরিয়ার মানুষ সংঘাত সহ্য করে যাচ্ছেন। আর রক্তপাত নয়, এখন এর একটি রাজনৈতিক সমাধান তাদের প্রাপ্য। যে সমাধান তাদের শান্তিপূর্ণ একটি ভবিষ্যৎ দিতে পারবে।
No comments