দিল্লিকে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ করতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নাটকীয়তা আর কখনো ঘটেনি। দীর্ঘ পনেরো বছরের শাসনের পর শেখ হাসিনার পতনের গল্প যেন এক রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার। পালানোর আগে ৫ আগস্ট সকালে তিনি দিল্লির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ফোন করে ঢাকার উপর ভারতীয় হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। কিন্তু তাও ফলপ্রসূ না হওয়ায়, শুরু হয় তার গোপন পালানোর পরিকল্পনা।
শেখ হাসিনা এবং তার বিশ্বস্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পালানোর প্রস্তুতি শুরু করেন। ৪ আগস্ট রাত থেকেই প্রস্তুত ছিল বিমানবাহিনীর ‘সি-১৩০ জে’ ট্রান্সপোর্ট বিমান। কিন্তু তার পালানোর নাটকের প্রথম ধাপটি ছিল গণভবনের ভেতরে একাধিক বৈঠক।
গভীর রাতে সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে উত্তেজনার চরম পর্যায়ে পৌঁছান শেখ হাসিনা। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তিনি বলেন, "আমাকে গুলি করে মেরে ফেল।" সেনা কর্মকর্তারা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনোভাবেই তার অনড় মনোভাব বদলাতে পারছিলেন না। গণভবনে ৪ আগস্টের রাতটি ছিল ঘটনাবহুল। সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দিলে তিনি রাগারাগি করে তাদের সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেন। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, তার বোন শেখ রেহানা তাকে শান্ত করার জন্য পা জড়িয়ে ধরেন। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে ফোনে কথা বলার পর পদত্যাগে রাজি হন।
শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুব গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সমন্বয় করে ৪ আগস্টের মধ্যেই পরিকল্পনাটি তৈরি করেন। পরিকল্পনার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন এসএসএফের ডিজি মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান এবং সেনাবাহিনীর কিউএমজি লে. জেনারেল মুজিব।
আরও জানা যায়, শেখ হাসিনা ৪ আগস্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে ফোন করে জরুরি অবস্থা জারির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। সেনাপ্রধানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন গুলিবর্ষণ করে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমনের। তেমনি বিমানবাহিনী প্রধানকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালাতেও বলেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার কোনো অভিপ্রায় বা হুকুম তামিল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে প্রাণরক্ষার জন্য স্যুটকেস গুছিয়ে নিরাপদ অবস্থানে যেতে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। গণভবনে দুপুরের খাবার রান্না করা ছিল। কিন্তু খাওয়ার সময়ও ছিল না। বিমানবাহিনীর ‘সি-১৩০ জে’ বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময় তিনি ১৪টি স্যুটকেস সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং স্যুটকেসগুলো ঠিকঠাকভাবে বিমানে উঠেছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বিমানে করে আরও পালিয়েছেন তার বোন শেখ রেহানা, জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী এবং একটি শিশু মেয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা তেজগাঁও কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিমানবাহিনীর ‘সি-১৩০ জে’ বিমানে করে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ফ্লাই করেন। বিমানটির পাইলট ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামীম রেজা ও উইং কমান্ডার গোলাম রসূল চৌধুরী।
গণভবন থেকে গাড়িতে করে কুর্মিটোলা যাওয়ার জন্য প্রথমে জেদ ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তাকে নিষেধ করা হলেও গাড়িতে ওঠেন এবং গাড়িবহর গণভবন থেকে কুর্মিটোলার উদ্দেশে যেতে থাকে। গাড়িবহরের অগ্রগামী ক্লিয়ারিং অফিসার (কর্নেল পদমর্যাদার) জানান, সামনে বড় মিছিল আছে, গাড়িবহর নিয়ে যাওয়া যাবে না। তখন গাড়িবহরে থাকা এসএসএফের একজন অপারেশন অফিসার বলেন, ‘আমরা গুলি করে করে এগিয়ে যাব।’ কিন্তু গাড়িবহরে থাকা জুনিয়র অফিসাররা বলেন, ‘ঝুঁকি নেওয়া আমাদের ঠিক হবে না। মবের সামনে পড়লে সবাই মারা যেতে পারি। ফলে গাড়িবহর ঘুরিয়ে গণভবনের পেছনে বাণিজ্যমেলার মাঠে (আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পশ্চিম পাশে) নেওয়া হয়। এরই মধ্যে রাশিয়ার তৈরি হেলিকপ্টার (এমআই-১৭) কল করে এনে প্রস্তুতও রাখা হয়। হেলিকপ্টারে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী এবং একটি মেয়েশিশু (সম্ভবত তারেক সিদ্দিকীর পরিবারের হতে পারে)। হেলিকপ্টারটি সেখান থেকে কুর্মিটোলায় যায়। পাইলট ছিলেন এয়ার কমোডর আব্বাস ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন রায়হান কবির। হেলিকপ্টারটি ১২টা ৩০ মিনিটে কুর্মিটোলায় পৌঁছালে বেস কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে থাকা এয়ার ভাইস মার্শাল এবিএম আউয়াল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রিসিভ করেন। এ সময় উইং কমান্ডার জাকি আনোয়ার গণভবন থেকে সঙ্গে আনা শেখ হাসিনার ১৪টি স্যুটকেস বিমানে উঠিয়ে দেন। এ সময় শেখ হাসিনা কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। শুধু স্যুটকেসগুলোর খোঁজ নেন, সবগুলো বিমানে উঠেছে কি না। সঙ্গে বিমানে আরও ওঠেন ডিজি এসএসএফ, এসএসএফের তিন থেকে চারজন কর্মকর্তা এবং ফ্লাইট লে. পদবির একজন লেডি কর্মকর্তা। কুর্মিটোলা পৌঁছার ১০ মিনিটের মধ্যেই শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তারেক সিদ্দিকীকে নিয়ে বিমানটি উড্ডয়ন করে। এ সময় সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমানের ওঠানামা বন্ধ করে দেয়। ‘সি-১৩০ জে’ বিমানটি ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে উড্ডয়ন করে, যাতে রাডারের সঙ্গে যোগাযোগ সংযোগ না হয়। সাধারণত বিমান উড্ডয়ন করে নর্থবেঙ্গল হয়ে ঘুরে যায়। কিন্তু এ বিমানটি আকাশে উঠেই নর্থবেঙ্গলে না গিয়ে ত্রিপুরার (আগরতলা) দিকে চলে যায়, যাতে খুব অল্প সময়ে সীমান্ত পার হতে পারে। এরই মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ক্লিয়ারেন্স পেয়ে বিমানটি সরাসরি দিল্লি চলে যায় এবং নামে দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে। সেখানে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। জানা গেছে, হাসিনা সেখানেও অজিত দোভালকে ঢাকায় আক্রমণ করতে বলেন। শেখ হাসিনাকে হিন্দন ঘাঁটিতে নামানোর পর রিফুয়েলিং করে বিমানটি কর্মকর্তাদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এর আগেও দফায় দফায় ঢাকায় এসেছেন। বিশেষ বিমানে করে তিনি আসতেন। গণভবনে যেতেন কিন্তু তার আসা-যাওয়ার কথা গোপন রাখা হতো।
‘শেখ হাসিনা পালায় না’—এই দাবির মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুরো দেশ হতবাক। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, সেনাবাহিনীর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি, এবং পুলিশের অস্ত্রশূন্য অবস্থা, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, শেখ হাসিনার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
৫ আগস্ট সকালে শেখ হাসিনার বিমানে ওঠার মুহূর্ত ছিল অত্যন্ত নাটকীয়। গণভবন থেকে কুর্মিটোলা পর্যন্ত তার যাত্রা ছিল কঠোর গোপনীয়তায় আচ্ছাদিত। সেনাবাহিনীর ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে যাত্রা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখা, এবং রাডার এড়িয়ে বিমান চলার পরিকল্পনা, সবই ছিল এক মহাকাব্যিক পালানোর অংশ।
শেখ হাসিনার এই নাটকীয় বিদায়ের পর রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন শক্তির উদ্ভব ঘটেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, ‘চব্বিশের বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পাওয়া গণঅভ্যুত্থান, এবং সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থান মিলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই গল্প যেন এক রাজকীয় নাটকের চিত্রনাট্য। শেখ হাসিনার ক্ষমতার শেষ অধ্যায় শুধু তার রাজনৈতিক জীবনের নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায় হয়ে থাকবে।
No comments