বিদ্রোহী এইচটিএস কারা ?
হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস তথা সিরিয়া মুক্তির সংগঠন) এর সূচনা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে। সরকারিবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পুরোটা সময়ে সংগঠনটি একটি বিপজ্জনক বিরোধী শক্তি হিসেবে টিকে ছিল। ২০১৮ সালের মে মাসে সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের (এফটিও) হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এইচটিএসকে একটি সিরিয়ার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৭ সালে আল-কায়েদার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ ঘটালেও সালাফি-জিহাদি মতাদর্শ ধরে রেখেছে এইচটিএস।
সংগঠনটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে এইচটিএসের ইতিহাস, নেতৃত্ব ও বর্তমান কৌশলগত লক্ষ্যগুলো নিয়ে সারসংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে।
আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক
২০১১ সালে সিরিয়ায় আসাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় আল-কায়েদার সহযোগী হিসেবে গঠিত হয় এইচটিএস। এই সংগঠনের আগের নাম ছিল জাবহাত আল-নুসরা। নুসরার নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এমন একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যারা পারস্য উপসাগরের নিজস্ব দাতাদের সুরক্ষিত করে। পাশাপাশি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে কর ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ করত। ধাপে ধাপে বিদ্রোহীরা হামলা পরিচালনায় দক্ষ হয়ে উঠে এবং এভাবে ক্রমবর্ধমান যোদ্ধাদের তারা আকৃষ্ট করত। যার ফলে এই বিদ্রোহী দলে যোদ্ধার সংখ্যা দ্রুত সময়ের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আল-কায়েদার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রকাশ্য বিচ্ছেদ ঘটার পরও জাবহাত আল-নুসরা আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। ইসলামিক স্টেটের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিই নুসরার প্রাথমিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে ২০১৬ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে আল-জোলানি জাবহাত আল-নুসরার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। পরে জাবহাত ফাতাহ আল-শামের প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন যে, আল-কায়েদার সঙ্গে নতুন গোষ্ঠীর আর বাহ্যিক কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, আল-জোলানি আনুষ্ঠানিকভাবে আল-কায়েদার সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক ছিন্ন করলেও গোপনে সম্পর্ক বজায় রেখে কৌশলগত ও কার্যক্রমের বিষয়ে নির্দেশনা গ্রহণ করত। তবে আল-জোলানির এই ঘোষণা আল-কায়েদার আমির আইমান আল-জাওয়াহিরির পরামর্শ ছাড়াই করেছিলেন। যার কারণে সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল।
২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে জাবহাত ফাতাহ আল-শাম নতুন করে পুনর্গঠিত হয়। এটি হারাকাত নুর আল-দীন আল-জিনকি, লিওয়া আল-হক, জাইশ আল-সুন্না এবং জাবহাত আনসার আল-দীনসহ কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে একীভূত হয়ে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) প্রতিষ্ঠা করে। এই পর্যায়ে আল-কায়েদার নেতারা এইচটিএসকে একটি স্বাধীন সালাফি-জিহাদি সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের মতে, এইচটিএস অবৈধভাবে আল-কায়েদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করেছে।
কয়েকজন বিশিষ্ট জিহাদি এইচটিএস সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেন এবং সংগঠনকে বিভেদ সৃষ্টি ও আল-জাওয়াহিরির প্রতি তাদের আনুগত্য ভঙ্গ করার জন্য প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। আল-জাওয়াহিরি নিজেও একাধিক বিবৃতি দিয়ে এই সংযুক্তির বিরোধিতা করেন। তিনি একে ‘চুক্তির লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, এটি তাদের প্রত্যাশিত ঐক্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার দাবি, এইচটিএস কখনোই আল-কায়েদার নেতৃত্ব দ্বারা অনুমোদিত হয়নি।
তবে বর্তমান সময়ে এস এইচটিএসের দাবি, তারা একটি স্বাধীন সত্তা। তারা আল-কায়েদা বা অন্য কোনো সংগঠন বা দলের অনুসারী নয়। তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেছে এটি প্রমাণ করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কোনো আনুগত্য নেই। এমন দাবির পরেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক এখনো রয়েছে। এমনকি তারা এইচটিএসকে সিরিয়ার বিদ্রোহে আল-কায়েদার অবস্থানকে এগিয়ে নিতে এবং তাদের নিজেদের লক্ষ্য সাধনে একটি মাধ্যম হিসেবে অভিহিত করেছে তাদের বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের (এফটিও) তালিকায়।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, তাদের মধ্যে এখনো যোগাযোগ রয়েছে। একাধিক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এইচটিএস এবং তার অঙ্গসংস্থাগুলো এখনো আল-কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে।
নেতৃত্ব ও কৌশল
বর্তমানে এইচটিএসের নেতৃত্ব আবু মুহাম্মদ আল-জোলানির হাতে রয়েছে। তবে আল-কায়েদা থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে গোষ্ঠীটির লক্ষ্য কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও আল-জোলানির প্রকাশ্য বিবৃতিগুলো মাঝে মাঝে বিস্তৃত লক্ষ্য নির্দেশ করে। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ‘এর মাধ্যমে… আমরা কেবল দামেস্কে পৌঁছাব না বরং আল্লাহর অনুগ্রহে জেরুজালেম আমাদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করবে’। তবে আল-কায়েদার বিশ্ব খেলাফত এইচটিএসের প্রকাশনায় বেশির ভাগই অনুপস্থিত। তার পরিবর্তে এইচটিএস স্থানীয় পর্যায়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রেখেছে। আর তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো, সিরিয়ায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অবৈধ (আসাদ) শাসনকে উৎখাত এবং ইরানি মিলিশিয়াদের বিতাড়িত করা।
এই লক্ষ্য অর্জনে আল-জোলানি একটি বহুমুখী কৌশল তৈরি করেছেন। প্রথম ধাপে তারা ২০১৮ সালের আগস্টে দাবি করেছে তারা ইরানি মিলিশিয়াদের এবং ফু’আ ও কাফরিয়া নামক দুই শহরের মিলিশিয়া সদস্যদের সরিয়ে ফেলেছে। এই মিলিশিয়ারা পুরো অঞ্চলের জন্য একটি হুমকি ছিল এবং তাদের কারণে ধর্মীয় সংঘর্ষও বেড়ে উঠছিল। আসাদের শাসনব্যবস্থাও তাদেরকে তার স্বার্থে ব্যবহার করছিল। দ্বিতীয় ধাপ ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চলমান ছিল। এই ধাপে ছিল ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযান। যাদের আল-জোলানি ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় ধাপটি হলো, স্থিতিশীলতা অর্জন বা উত্তর সিরিয়াকে শক্তিশালীকরণ এবং রক্ষা করা। যাতে আরও অঞ্চল হারানোর আশঙ্কা কমে আসে। একইসঙ্গে এই ধাপে সামরিক কৌশলের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক কৌশলও গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে এইচটিএস সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা চালায়। এ সময় তারা আসাদ সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের লিয়াজোঁ আলোচনারও প্রয়োজন মনে করেনি।
No comments