ট্যানারি শাহীন বহাল তবিয়তে
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের দুই মামলার তালিকাভুক্ত আসামি হয়েও প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের প্রভাবে অবৈধভাবে সভাপতি পদ দখলে রেখেছেন। সংগঠনকে ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সেলিম আহমেদের ছোট ভাই এই শাহীন।
সূত্রমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ধানমন্ডি-হাজারীবাগ এলাকায় আন্দোলন পণ্ড করতে ট্রানারি শাহীন আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীদের অর্থ জোগানে সহযোগিতা করতেন। এছাড়া ধানমন্ডি এলাকায় ছাত্র হত্যার দায়ে ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা দুটি মামলার একটিতে ৮২ নম্বর আসামি, অপরটিতে ৬২ নম্বর আসামি হলেও জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে ধানমন্ডি থানার পুলিশ এ বিষয়ে রহস্যজনক নীরব ভূমিকা পালন করায় ছাত্র হত্যা মামলার বাদী, ধানমন্ডিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আহত ও নিহতদের পরিবার এবং সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
জানতে চাইলে ধানমন্ডি থানার ওসি আলী আহমদে মাসুদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অভিযুক্তের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে শিগগির আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হত্যা মামলার আসামি হলে এবং প্রাথমিক তদন্তে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে শাহীন আহমেদকে ছাড় দেওয়া হবে না। এর বাইরে তার অন্য অপরাধের বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হবে।
জানা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার ও আওয়ামী লীগ সভাপতি মুনসুর আহমেদের ছেলে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সেলিম আহমেদের ছোট ভাই শাহীন আহমেদ। বড় ভাই সেলিম আহমেদ ও শেখ পরিবারের সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপসের নির্দেশে হাজারীবাগ ও ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ডের হুকুমদাতা হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ সব কর্মীর কাছে পরিচিত।
এলাকাবাসী সূত্রমতে, ২০০৯ সালে আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় শেখ পরিবারের সদস্য সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপসের নির্দেশে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের পলায়নে সহযোগিতা এবং নিহত কয়েকজনের মরদেহ গুমে জড়িত ছিলেন এই ট্যানারি শাহীন। তিনি সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশভ্রমণে সফরসঙ্গী হয়ে গেছেন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভোল পাল্টে চলার চেষ্টা করছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, শাহীন তার অপরাধের সম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে কৌশলে বিএনপির হাইপ্রোফাইল নেতাদের সঙ্গে গভীর সখ্য তৈরি করেছেন। আজ শুক্রবার তার বড় মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে রাজধানীর সেনাকুঞ্জে এক জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে বিএনপির নেতাদের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা পলাতক ও গা-ঢাকা দিলেও আওয়ামী লীগ নেতার ছোট ভাই শাহীন ৫ আগস্টের পর সাময়িক নিশ্চুপ থাকলেও এখন অনেকটা বেপরোয়া। দুটি ছাত্র হত্যা মামলার আসামি, অথচ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে না। কয়েক দিন আগেও হাজারীবাগ এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাড়ি জোরপূর্বক দখল করে। এ ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে ওই ভুক্তভোগী পরিবার। এছাড়া অনেকটা নির্ভয়ে তিনি গোপনে সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষ হয়ে হাজারীবাগ এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য কাজ করছেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের স্বঘোষিত সভাপতি বনে যান তিনি। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ আছে যে, দুই বছর করে দুই মেয়াদে চার বছরের বেশি সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করা যাবে না। অথচ আওয়ামী লীগের আমলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি সভাপতির পদে বহাল থেকে ট্যানারির সব কল-কারখানার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন একাই। এছাড়া বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেশি-বিদেশি ও বিশ্বব্যাংকের দেওয়া সব অনুদানের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’ মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি দাবি করেন, কোনো হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এরপর ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি।
ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কোনো হত্যা মামলার আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারবে না। পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। চাঁদাবাজি ও দখলবাজদের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স। শাহীন আহমেদ যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে তদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাজারীবাগ এলাকায় কোনো চাঁদাবাজ ও দখলবাজের স্থান নেই। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিভিন্ন মামলার যেসব আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।’
No comments