Adsterra

ভুল সংস্কার নীতি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে বিলম্বিত করছে

ভুল সংস্কার নীতি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে বিলম্বিত করছে, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news, banglade

হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ‘সংস্কার’ এখন একটি জনপ্রিয় শব্দ হয়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে নির্বাচন সংস্কারের পথে অন্তরায়, যেন বাংলাদেশকে এই দুইয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির কয়েকদিন পর দায়িত্ব গ্রহণ করে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছে।

ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসেরও কিছু বেশি সময় পর, ড. ইউনূস ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন, যা বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংবিধান সংস্কারের কাজ করবে, যাতে বাংলাদেশে আর কখনো ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারী শাসন ফিরে না আসে।

ইউনূস বলেন, ‘একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পুলিশ প্রশাসন, সরকারি প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার অপরিহার্য।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন যে সংস্কার আগে পরে নির্বাচন হবে।

২৫ ডিসেম্বর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু একটি নির্বাচন বা ভোটের জন্য এত মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেননি।’ এক মাস আগে, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পরই পরবর্তী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু উপদেষ্টার বার্তা হলো, নির্বাচন সংস্কারের পথে অন্তরায়, যেন বাংলাদেশ কেবল একটি বেছে নিতে পারে: সংস্কার বা নির্বাচন। অর্থাৎ নির্বাচনের পর কোনো সংস্কার আর সম্ভব নয়।

এই মিথ্যা দ্বৈততা সম্ভবত সংস্কার সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে এসেছে এবং একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছাত্রনেতৃত্বাধীন একটি নতুন দল গঠনের জন্য সময় ক্ষেপণের কৌশল হতে পারে।

বাংলাদেশ সবসময়ই শাসনব্যবস্থার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকাল গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করে দেয়। এছাড়া, হাসিনা সরকার প্রায়ই নীতিমালা তৈরি ও পরিবর্তন করেছে তার ঘনিষ্ঠদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। ফলে, প্রায় সব প্রধান প্রতিষ্ঠান এবং অনেক নীতিরই সংস্কার এখন অতীব প্রয়োজন। 

আমরা যখন এই সমস্ত কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষায় রয়েছি, তখন স্বীকার করতে হবে যে এই সংস্কার পরিকল্পনাগুলো যেন কোনো ইচ্ছার তালিকা না হয়ে যায়, যা রাতারাতি বাস্তবায়ন করা হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ ছাড়া, তাৎক্ষণিক সমাধানকে সংস্কারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।

উদাহরণস্বরূপ, প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সহনশীলতার গুরুতর অবক্ষয়ের শিকার। সম্প্রতি নারীদের ফুটবল টুর্নামেন্ট বাধাগ্রস্ত করতে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হামলা কিংবা ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন, ছাত্র শিবিরের প্রকাশ্যে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন নিষিদ্ধ করার আহ্বান তার কয়েকটি উদাহরণ। ট্রান্সফোবিয়াও বাড়ছে, যেখানে ট্রান্সফোবিক গোষ্ঠীগুলো সমঅধিকারের পক্ষে কাজ করা LGBTQ+ কমিউনিটি ও তাদের সমর্থকদের হয়রানি করছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোঝা উচিত যে এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছিলেন, তখন ভিন্নমতাবলম্বী ব্লগার ও প্রকাশকদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছিল। সেই সময় তার পুত্র সরকারের নিষ্ক্রিয়তা রক্ষার জন্য সাফাই গেয়েছিলেন। সংবিধান সংস্কার কমিশন বহুত্ববাদভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে এবং বাংলাদেশ সংবিধানে বহুত্ববাদ ও সমতাকে মৌলিক নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। তবে, এটি রাতারাতি দেশের সমাজের সব উপাদানকে বহুত্ববাদী করে তুলতে পারবে না।

একটি বহুত্ববাদী সমাজ গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্যমত্য গঠন, সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়নে সম্পদের যথাযথ বরাদ্দ, অগ্রগতির পর্যবেক্ষণ এবং পুরো প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হতে এক দশকেরও বেশি সময় লাগতে পারে। যেকোনো সিরিয়াস জননীতির শিক্ষার্থী একমত হবেন যে, বহুত্ববাদী সমাজ গঠন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ নয়; এটি দেশের সকল রাজনৈতিক অংশীজনের সম্মিলিত দায়িত্ব। অন্যদিকে, নির্বাচন শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও, নিয়মিত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জনগণের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দেয়। তাই নির্বাচন সংস্কার প্রক্রিয়ার পরিপন্থী নয়; বরং এটি সম্পূরক।

অতএব, কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন আয়োজন করা কার্যত অসম্ভব। এর সর্বোত্তম করণীয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ডাটা-ভিত্তিক লক্ষ্য, নির্দিষ্ট সময়সীমা ও বাস্তবায়ন কৌশলসহ একটি সংস্কার রোডম্যাপ প্রণয়ন করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতিটি ধাপে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে সংস্কারগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বীর শহিদ ও অকুতোভয় আন্দোলনকারীদের স্মরণে ও সম্মানে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস বাংলা বসন্ত

যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার নিয়ে আন্তরিক হয়, তবে তাদের উচিত জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা, সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা প্রস্তাব করা। এই দিক দিয়ে, জাতীয় ঐক্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে ইউনূস ইতোমধ্যে কিছু অগ্রগতি সাধন করেছেন, যা প্রশংসনীয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা এবং তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে এসব সংস্কারের প্রতি সমর্থন জানানো, যাতে ভবিষ্যতে জনগণ তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.