যে কারণে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিএনপির আপত্তি
রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এই উদ্যোগের মাঝপথে এসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে।
বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তির দুবারের বেশি না আসা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে একইসঙ্গে না থাকা, সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে চার বছরে কমিয়ে আনার মতো প্রধান কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি।
গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এই বিষয়গুলোয় আপত্তির কথা জানায় দলটি।
মূলত বিএনপির ওই প্রস্তাব ঘিরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রাজনীতির মাঠে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। টানা দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা নিয়ে বিএনপির আপত্তির বিষয়টি ঘিরেই সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে।
বিএনপির যুক্তি হচ্ছে— একটানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে কোনো এক ব্যক্তির না থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে তিনি দুই মেয়াদের পর বাকি জীবনে আর কখনো এই পদে আসতে পারবেন না– এরকম বিধান করা ঠিক হবে না। বিএনপি চাচ্ছে টানা দু মেয়াদের পর গ্যাপ দিয়ে কেউ পরে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করে প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ না থাকার কারণে টানা চার মেয়াদ ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় থেকে তিনি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে নানা প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন, অন্যদিকে নিজের ক্ষমতাকেই পাকাপোক্ত করেছেন। যে কারণে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদের বিষয়টি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে যে কেউ ক্ষমতায় গিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন, কোনো সময়সীমা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদের শাসন আটকানো না গেলে একদিকে যেমন স্বৈরাচারী সিস্টেম বদল করা যাবে না, অন্যদিকে রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিকাশও ঘটবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো এসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করে বলে জানানো হয়। এখন বিএনপির আপত্তির কারণে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ও চার বছর মেয়াদি সরকারের মতো বিষয়গুলো সংস্কারে আটকে যেতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এটা আমাদের দলগত সিদ্ধান্ত। তবে আমরা সব সময় উইন্ডো ওপেন রেখেছি যে আমরা আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে যৌক্তিকভাবে যে কোনো কিছুই আমরা মেনে নেবো।
এই সংস্কারের পেছনে যুক্তি কী ?
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংস্কারে উদ্যোগ এর আগেও নেওয়া হয়েছিল ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।
তবে পরের বছর ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পরই আদালতের রায়ের মাধ্যমে বাতিল করা হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
এরপর দলীয় সরকারের অধীনে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। প্রতিবারই ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ, আর প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা সরকারে থাকাবস্থায় প্রায় তিন দশকে বাংলাদেশে একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করা হয়।
গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নানা পরামর্শও নেয়।
পরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিটে ছক আকারে দিয়ে দলগুলোর মতামত চেয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি কখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী পদের কোনো সুনির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। সেই সঙ্গে একটানা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে সে বিষয়টিও বেঁধে দেওয়া নাই বাংলাদেশের সংবিধানে। ফলে শেখ হাসিনা টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাকে ফ্যসিস্ট তকমা নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় পদ থেকে।
বিএনপি গত মঙ্গলবার সংস্কার কমিশনের কাছে যে প্রস্তাব করেছে সেখানে তারা নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে। তবে বিএনপি একটানা দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকার বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছে ঐকমত্য সংস্কার কমিশনের কাছে।
কেন সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের সময় বেঁধে দিতে চাইছেন তার একটি যুক্তিও তুলে ধরেন সংস্কার কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম।
তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমিরি পুতিনের উদাহরণ টেনে বলেন, রাশিয়ার আইনেও টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগ নাই। যে কারণে পুতিন কখনো রাষ্ট্রপতি, কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা থাকেন। টানা প্রায় ২৬ বছর ধরে এই পদে আছেন তিনি।
তিনি বলছেন, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো কিংবা ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ফেরানোর জন্যই অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের পরামর্শে দুই মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি যুক্ত করেছে সংস্কার কমিশন।
প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদে বিএনপির আপত্তি কেন ?
ঐকমত্য কমিশনের কাছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।
মঙ্গলবার ওই সুপারিশ জমা দেওয়ার পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা চান যে টানা তিন মেয়াদ কেউ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তবে এক মেয়াদ বাদ দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়া যাবে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষেত্রেও দুই মেয়াদ সময় বেঁধে দেওয়া আছে। শুধু প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন মেয়াদ বলা বলা নাই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের প্রস্তাবনা পরপর দুবার যদি কেউ প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তাকে একবার গ্যাপ (বিরতি) দিতে হবে। তারপর আবার প্রধানমন্ত্রী হতে বাঁধা নেই। এটাকে অনেকে মনে করতে পারে আমরা লাইফ টাইমে দুবারের কথা বলেছি। বিষয়টা তেমন না। তার মানে পরপর তিনবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন কোনো দলের মধ্যে যদি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা বজায় থাকে অন্যদিকে শতভাগ নিরপেক্ষ ভোটে যদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তাহলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে সংস্কার কমিশন বিবেচনা করতে পারে।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুনিরা খান বলেন, টানা দুই মেয়াদে একজনের প্রধানমন্ত্রী থাকা উচিত না। কিন্তু পরবর্তীকালে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে যদি কোনো নেতার দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের মধ্যে যদি সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা থাকে এবং তিনি যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তার পদে বসার অধিকার থাকা উচিত।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুবারের বেশি থাকতে পারেন না।
একই সঙ্গে কেউ প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না বলে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, সে বিষয়েও ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। এটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয় বলে মত তাদের।
সরকারের মেয়াদকাল নিয়েও আপত্তি
সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ প্রস্তুত করেছে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করারও প্রস্তাব করেছে।
বিএনপি ঐকমত্য কমিশনে যে প্রস্তাব জমা দিয়েছে, তাতে তারা সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ নিয়ে দলের পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করারও বিরোধিতা করেছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের যে প্রস্তাব সেই প্রক্রিয়াতেও সায় নেই দলটির।
কিন্তু বিএনপি কেন সরকারের চার বছর মেয়াদ নিয়ে আপত্তি তুলেছে সেই প্রশ্নও ছিল দলটির নেতাদের কাছে।
জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যে পাঁচ বছর মেয়াদের বিষয়টি আছে সেটাই স্টান্ডার্ড, আমরা ওভার নাইট পরিবর্তন করে ফেলতে পারবো না।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারের মেয়াদ যদি এক বছর কমানো হয় তাতে দেখা যাবে যে অনেক সরকারই সফলতার সঙ্গে প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও সরকার পরিচালনা করতে পারবে না। কারণ এমন অনেক পরিকল্পনা রয়েছে যেটা বাস্তবায়নের জন্য চার বছর যথেষ্ট সময় পাবে না।
তবে সংস্কার কমিশনের যুক্তি, পাঁচ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। কখনো যদি কোনো সরকার ব্যর্থতার প্রমাণ দেয় তখন সেই সরকারের মেয়াদ শেষ কিংবা তার পতনের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়। ফলে দেশের মধ্যেও এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয় নির্বাচনের জন্য।
ড. আব্দুল আলীম বলেন, চার বছর যথেষ্ট সময়। সে যদি চায় চার বছরে অনেক কিছু করতে পারে। তাতে অন্য দল বিরক্ত হয় না। সব কিছু বিবেচনায় থেকে আমরা এই ধরনের প্রস্তাব করেছি।
আর বিশ্লেষক মুনিরা খান বলেন, পাঁচ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। কোনো দল একটানা পাঁচবছর ক্ষমতায় থাকলে স্বৈরাচারের বীজও বপনের সুযোগ থাকে।
No comments