রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে ?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ একদিকে উদ্বাস্তু, অন্যদিকে রাষ্ট্রহীন। সামরিক নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। তখন রোহিঙ্গা সংখ্যা ৭ লাখের মতো হলেও এখন সংখ্যাটা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী, এই রোহিঙ্গা নিয়ে দীর্ঘদিন আমরা বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে রয়েছি। বিষয়টি শুধু জাতীয় স্তরে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (UNHCR) এবং অন্যান্য মানবিক সংস্থার সহায়তায় সরকার এখনো তাদের আশ্রয়, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সফর করছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বৃহস্পতিবার চার দিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন আন্তোনিও গুতেরেস। রবিবার তিনি দেশত্যাগ করবেন। এবারের বাংলাদেশ সফরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করবেন জাতিসংঘ মহাসচিব। আজ শুক্রবার এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করবেন আন্তোনিও গুতেরেস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরে কি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের কোনো পথ উন্মুক্ত হবে?
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর মানবিক সহায়তাগুলো জোগাড় করার ওপর একটি ভূমিকা রাখবে। আমরা চাই রোহিঙ্গাদের পুষ্টির চাহিদা যাতে কোনোভাবে কম্প্রোমাইজ না হয়। সেজন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন হয়, প্রতি মাসে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার রোহিঙ্গাদের জন্য দরকার। আমরা আশা করছি, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর এখানে বিশ্বের নজর ফিরিয়ে আনবে। রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা আসে সেটা যেন বন্ধ না হয়, তাতে যেন কোনো প্রভাব না পড়ে।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করবে জাতিসংঘ। তার সঙ্গে ফিনল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া যুক্ত হয়েছে কো-স্পন্সর হিসেবে। আমরা আশা করছি, জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরকে ঘিরে এই আয়োজনে আরও ডেভেলপমেন্ট হবে।’ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করতে হলে, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার এবং নিরাপত্তা প্রদান করে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। আর জাতিসংঘ মহাসচিব এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
আমেরিকার হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের ওপর চীনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি। মিয়ানমারে অবকাঠামো এবং জ¦ালানি খাতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। তা ছাড়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে মিয়ানমার। দশকের পর দশক ধরে অর্থনৈতিক স্বার্থে চীন কখনো মিয়ানমারের সরকারের বিপক্ষে যেতে চায়নি। দেশটিতে যা কিছু ঘটুক না কেন বিনিয়োগ ও ব্যবসার স্বার্থে চীন সেগুলোর বিরুদ্ধে চুপ থেকেছে। এর মানে, মিয়ানমারের প্রতি চীনের সমর্থন এবং সহানুভূতি রয়েছে। এ রকম অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে চীন সফরে যাচ্ছেন। সেখানে অবশ্যই এই বিষয়টি যে আলোচনায় আসবে, তা অনুমান করা যায়। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন কতটুকু ভূমিকা পালন করবে, তা বলা কঠিন।
আসলে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত অবস্থানে নিয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। সরকার যেমন বিশ্বাস করে, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরের ফলে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি আবার বৈশ্বিক আলোচনায় আসবে, আমরাও তেমনটি চাই। আসলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল সমস্যা, যার সমাধান সহজ নয়। এর মধ্যে গোদের উপর বিষফোড়া হচ্ছে, এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ জড়িয়ে পড়েছে অপরাধের সঙ্গে। মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে না পারে, তবে এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয়, তা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরাই ভালো জানেন। আমরা প্রত্যাশা করি, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং কূটনৈতিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক জোরালো চাপের মাধ্যমে হয়তো একটি স্থায়ী সমাধান নিয়ে আসবেন।
No comments