খাদ্যসংকট নিরসনে ইসলামের ভূমিকা
বর্তমান পৃথিবীতে খাদ্যসংকট খুবই পরিচিত ও সাধারণ একটি সমস্যা। প্রযুক্তির বহুমুখী উৎকর্ষের এ সময়েও আধুনিক রাষ্ট্রগুলো তাদের জনগণের খাদ্যসংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। অথচ সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে ইসলাম খাদ্যসংকট মোকাবিলার বহুমুখী সমাধান আমাদের বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে।
খাদ্যসংকট নিরসন করার ক্ষেত্রে নবীজি (সা.) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কখনো জাকাতের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। কখনো সাহাবিদের উপার্জন ও ব্যবসায়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। কখনো উৎসাহিত করেছেন চাষাবাদ ও বৃক্ষরোপণ ইত্যাদির প্রতি। আবার কৃত্রিম খাদ্যসংকট তৈরির ব্যাপারেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। মোদ্দা কথা, যখন যেভাবে খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা প্রয়োজন, তখন তেমনি নির্দেশনা দিয়েছেন। আলোচিত প্রবন্ধে খাদ্যসংকট নিরসনে নবীজি (সা.)-এর কিছু দিকনির্দেশনা উল্লেখ করা হলো।
জাকাত আদায়ের নির্দেশ : খাদ্যসংকট নিরসনে ইসলাম যে সব উপায় আমাদের বলেছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো জাকাতব্যবস্থা। রাসুল (সা.) খাদ্যসংকট মোকাবিলায় সর্বপ্রথম মানুষকে জাকাতের আবশ্যকীয়তা ও গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন। কোরআন মাজিদেও বহু জায়গায় আল্লাহতায়ালা জাকাতের আবশ্যকীয়তা ও গুরুত্ব তোলে ধরেছেন।
নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর যখন আবু বকর (রা.) খলিফা হলেন, তখন আরবদের কোনো কোনো গোত্র জাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে আবু বকর (রা.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ওমর (রা.) আবু বকর (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ করবেন? অথচ নবী (সা.) বলেছেন, কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করলে তার জীবন, সম্পদ সবকিছু নিরাপদ হয়। উত্তরে আবু বকর (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ, যারা নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। কারণ জাকাত হলো সম্পদের হক। আল্লাহর শপথ, যে রশি তারা রাসুল (সা.)-কে জাকাত হিসাবে দিত, তা দিতেও যদি অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে তাদের সবার বিরুদ্ধে আমি লড়াই করব। ওমর (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ, আল্লাহতায়ালা আবু বকরের হৃদয় যুদ্ধের জন্য খুলে দিয়েছেন। অতঃপর আমি উপলব্ধি করলাম, ওমরের সিদ্ধান্তই সঠিক। (মুসনাদে আহমাদ)
উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ : আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পৃথিবীতে বিচরণ করবে।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল ২০) ওমর (রা.) এ আয়াতটি তেলাওয়াত করে বলেছেন, আল্লাহর পথে গাজী হয়ে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে তার অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাহাড়ের গিরিপথে আমার মৃত্যু হোক। আমি এমনটা কামনা করি। (সাইদুল খাতির ১৬৬)
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, এক আনসারি সাহাবি এসে নবীজি (সা.)-এর কাছে কিছু চাইলেন। নবীজি (সা.) তাকে বললেন, তোমার ঘরে কি কিছুই নেই? সে বলল, একটি কম্বল আছে। নবীজি (সা.) বললেন, তা আমার কাছে নিয়ে আসো। সে তা এনে নবী করিম (সা.)-কে দিলেন। তিনি সেটা বিক্রির ব্যবস্থা করলেন। বিক্রয় মূল্যের আংশিক অর্থ দিয়ে পরিবারের জন্য খাবার এবং অবশিষ্ট অংশ দিয়ে একটি কুঠার কিনে আনতে বললেন। সাহাবি কুঠার কিনে আনলে নবীজি (সা.) তাতে নিজ হাতে হাতল বেঁধে দিয়ে বলেন, এবার যাও, কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রি করো। তোমাকে যেন পনেরো দিনের মধ্যে না দেখি। অতঃপর তিনি নবীজির নির্দেশমতে কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রি করতে থাকলেন। একদিন পনেরো দিরহাম নিয়ে হাজির হলেন। এর কিছু দিরহাম দিয়ে কাপড় খরিদ করলেন আর কিছু দিরহাম দিয়ে ক্রয় করলেন কিছু খাদ্যসামগ্রী। রাসুল (সা.) বললেন, কেয়ামতের দিন চেহারায় ভিখারির ছাপ নিয়ে ওঠার চেয়ে এটাই তোমার জন্য উত্তম।
কৃত্রিম খাদ্যসংকট তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা : কৃত্রিম খাদ্যসংকট তৈরির ব্যাপারে ইসলামে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আবু উমামা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) খাদ্য গুদামজাত করতে নিষেধ করেছেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা) রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্যসামগ্রী গুদামজাত করে রাখে সে আল্লাহর ব্যাপারে দায়মুক্ত, আল্লাহও তার ব্যাপারে দায়মুক্ত। কোনো এলাকায় যদি একজন ব্যক্তি অভুক্ত থাকে, তাহলে আল্লাহতায়ালা উক্ত এলাকাবাসী থেকে দায়মুক্ত হন। (মুসনাদে আহমদ)
অপচয় না করার নির্দেশ : খাদ্যসংকট নিরসন করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই অপচয় ও অপব্যয় থেকে পরিপূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি অপচয় ও অপব্যয় থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত না হতে পারি, তাহলে খাদ্যসংকট শতভাগ নিরসন করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় আল্লাহতায়ালা অপচয় করতে নিষেধ করেছেন।
ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করা : আল্লাহতায়ালা ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক বরকত রেখেছেন। যে কেউ ব্যবসার মাধ্যমে নিজের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে। এতে খাদ্যসংকটের অবসান ঘটবে। তেই আমাদের করণীয় হলো, হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের নিয়েজিত করা এবং অপরকে উৎসাহিত করা।
চাষাবাদের প্রতি গুরুত্বারোপ : চাষাবাদের মাধ্যমেও খাদ্যসংকট প্রতিরোধ করা যায়। জাবির (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, কারও যদি সামান্য ভূমি থাকে, সে যেন তাতে চাষ করে অথবা অন্য কাউকে চাষ করতে দেয়। (ইবনে মাজাহ) রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো মুসলমান যদি একটি গাছ রোপণ করে, তাহলে সেই গাছ থেকে যা ভক্ষণ করা হবে তা সাদকা, যা চুরি হবে তা সাদকা, হিংস্র প্রাণী যা ভক্ষণ করবে তা সাদকা, পাখি যা খাবে তা সাদকা। তথা উক্ত গাছ থেকে যাই কমবে তাই তার জন্য সাদকা। (আলজামউ বাইনাস সহিহাইন) আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যদি কেয়ামত সংঘটিত হয় আর তখন তোমাদের কারও হাতে একটি গাছের চারা থাকে, তাহলে সম্ভব হলে সে যেন উক্ত চারা রোপণ করে। (মুসনাদ আবু দাউদ আততায়ালিসি)
No comments