কোন দল কোথা থেকে টাকা পাচ্ছে, কেন পাচ্ছে ?
আমাদের কাছে খুব পরিচিত একটা খবর হচ্ছে, জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আদায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি আরেকটি খবর পরিচিতি পাওয়াটা জরুরি। সেটা হচ্ছে, চাঁদাবাজির মতো ব্যবস্থা কীভাবে রাষ্ট্রের মধ্যে আরও অসংখ্য ‘রাষ্ট্র’ কিংবা ‘জমিদারি’ তৈরি করছে এবং এসব ‘জমিদারির’ একেকজন অধিপতির কাছে মানুষ কীভাবে তাদের আয়ের বড় একটা অংশ ‘খাজনা’ হিসেবে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের খবরে দেখছিলাম, বায়তুল মোকারমের আশপাশে ফুটপাতে ৪ ফুট বাই ৪ ফুট জায়গায় দোকানদারি করার জন্য বছরে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন ইজারাদারেরা। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দিনে তাঁদেরকে ৭০ টাকা চাঁদা দিতে হতো। সরকার পতনের পর নতুন যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, তাতে নতুন পক্ষকে তাঁরা আগের চেয়ে দ্বিগুণ চাঁদা দিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু নতুন পক্ষের দাবি, বছরে এককলীন দেড় লাখ টাকা।
কিছুদিন আগে, গাজীপুরের শ্রীপুরে সাঙ্গপাঙ্গসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে একটি বাজারে চাঁদা তোলে একটি সংঘবদ্ধ দল, তাতে নেতৃত্ব দেন বিএনপির একজন নেতা। একটি ভিডিওতে ওই নেতাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আপনাদের আমি বলছি, দোকানদার ভাইয়েরা। আজকে থেকে আপনারা খাজনা দেওয়া শুরু করে দেন। এখন এই মুহূর্তে আমার লোকজন খাজনা ওঠাবে। কেউ বাধার সৃষ্টি করলে তাকে কঠিনভাবে প্রতিহত করব।’
ভাইরাল হওয়া ভিডিওর সূত্র ধরে তাঁকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফুটপাতের হকার, ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাজারের সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, ডাব বিক্রেতাসহ বিপুলসংখ্যক মানুষকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মীদের ‘খাজনা’ দিয়েই চলতে হয়।
এর বিনিময়ে তাঁরা ব্যবসা করে জীবন চালান। রাজনীতি এই কারণেই বাংলাদেশে অত্যন্ত মুনাফাদায়ী ব্যবসা। রাজনীতি সে কারণেই এত রক্তপাতের। দলে দলে লোক ক্ষমতাসীনদের পতাকাতলে গিয়ে ভেড়ে। অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের নামে স্লোগান দেয়।
এর বিনিময়ে একেকটা বাজার, একেকটা হাট, একেকটা জলমহাল, একেকটা ফুটপাত বন্দোবস্ত দেওয়া হয় পার্টির পাতি ও উপনেতাদের কাছে। তাঁরা কিছু কর্মী বাহিনী পোষেন। পার্টির ফান্ডে চাঁদা দেন। তার বিনিময়ে জনগণের কাছ থেকে ‘খাজনা’ তোলেন। পরিবহন খাত তাঁদের চাঁদাবাজি ও মুনাফাবাজির আরেকটি বড় খাত। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পকেট উপচে পড়ে এ খাত থেকে। বিনিময়ে জনগণকে উপহার দেওয়া হয় চরম নৈরাজ্য। প্রতিদিন দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল আর জিম্মি দশা তার দৃষ্টান্ত।
এই প্রশ্নটা যৌক্তিক। কেননা, চব্বিশের অভ্যুত্থান সবখানেই জবাবদিহির প্রশ্নটাকে সামনে এনেছে। বিএনপি এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রভাবশালী দল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হলে বিএনপি তো পারেই সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিতে। রাষ্ট্র সংস্কারে তারা ৩২ দফা দিয়েছে। একইভাবে দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংস্কারের ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিলে নিশ্চিত করেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসত। অন্য দলগুলোর জন্যও দৃষ্টান্ত হতে পারত।
৫ আগস্টের আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগের পরিচয়ে এই চাঁদাবাজিটা করা হতো। ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে বেশির ভাগ জায়গাটা দখলে নিতে শুরু করে বিএনপি। কোথাও কোথাও কেউ বেশি মাত্রায় বাড়াবাড়ি করেছে এবং তাদের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। সংবাদ প্রকাশের পর তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু দেশজুড়ে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্কের সিংহভাগ অংশ আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপির নেতাকর্মীরা দখল করে নিয়েছে এমন অভিযোগ স্বীকার করতে নারাজ বিএনপি। ৫ আগস্টের পর থেকে এ রকম চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত প্রায় দেড় হাজার জনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। কিন্তু এটা শুধু বহিষ্কারের বিষয় নয়, এটা রাজনৈতিক দলগুলোর একটি স্বীকৃত চর্চা।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের বরাতে ৯ মার্চ ডেইলি স্টার শুধু ঢাকা শহরের পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির যে তথ্য দিয়েছে, সেটা অত্যন্ত ভয়াবহ। ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করা হয়। প্রতি মাসে এটি ৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আবার কখনো তা বেড়ে ৮০ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছায় বলে একটি সরকারি তদন্তে উঠে এসেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে আরও দেখা গেছে যে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
অভিযোগ থেকে বাদ যাচ্ছেন না অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরাও। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের নাম কিংবা পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়মিতই আসছে।
আমাদের এখানে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো টিকে আছেই এ রকম চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, তদবিরবাজির নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে। দলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের নেতা–কর্মীদের সিংহভাগের আয়ের একটা বড় উৎসই নানা নামে, নানা উপায়ে জনগণের কাছ থেকে ‘খাজনা’ তোলার নেটওয়ার্ক। এই রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুলিশও রাজনৈতিক দলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ফলে তারাও চাঁদার বড় ভাগীদার। বাংলাদেশে কৃষকেরা তাঁদের ফসল বিক্রি করতে গিয়ে দাম পান না আর ক্রেতারা বাজার থেকে কিনতে গিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন, তার বড় কারণ চাঁদাবাজির এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মাঝের কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীদের (এরাও রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার) সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীদের চাঁদাবাজি সেখানে যুক্ত হয়ে জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে নিয়ে যায়।
এ তো গেল দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের নেতা–কর্মীদের কথা। ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রে যাঁরা থাকেন, তাঁদের আয়ের এবং দল পরিচালনার ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয়, তার উৎসটা কী? এখানেই ব্যবসায়ীদের একটি অংশের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্রোনিতন্ত্র তৈরি হওয়ার প্রশ্নটি জড়িত।
সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি বার্তা সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর দলকে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা অর্থায়ন করছেন। তিনি কারও নাম বলতে চাননি, কারণ তাঁরা বিপদে পড়তে পারেন। নতুন দল হিসেবে যাত্রা শুরু করার আগে থেকেই ছাত্রদের সংগঠনটির অর্থায়নের উৎস নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে কয়েক জন সমন্বয়ক দামি গাড়িতে করে চলাফেরা করায় তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। এর উত্তরে একজন সমন্বয়ক যে উত্তর দিয়েছিলেন, সেটা আরও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। যাহোক, নতুন সংগঠন হিসেবে কার্যালয় ভাড়া, বিশেষ করে অভিষেক অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীর ঢাকায় সমবেত করার যে অর্থ দরকার, সেটা কোথা থেকে এসেছে, এ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
বিএনপি এনসিপির অর্থায়নের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করেছে। ছাত্রদলের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে, ধনী ব্যক্তিরা এনসিপিকে অর্থায়ন করেছেন, সেই অর্থায়নের বিপরীতে ধনী ব্যক্তিদের কী ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে সাধারণ একটি ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির কীভাবে প্রতিদিন ইফতার কর্মসূচিতে তিন লাখ টাকা ব্যয় করছে, তাদের অর্থের উৎস কী, সেটা তাঁরা জানতে চেয়েছেন।
এই প্রশ্নটা যৌক্তিক। কেননা, চব্বিশের অভ্যুত্থান সবখানেই জবাবদিহির প্রশ্নটাকে সামনে এনেছে। বিএনপি এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রভাবশালী দল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হলে বিএনপি তো পারেই সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিতে। রাষ্ট্র সংস্কারে তারা ৩২ দফা দিয়েছে। একইভাবে দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংস্কারের ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিলে নিশ্চিত করেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসত। অন্য দলগুলোর জন্যও দৃষ্টান্ত হতে পারত।
রাজনৈতিক দলের শীর্ষ একটি অংশ, ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী, আমলাতন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার একটি অংশ মিলে একটি সরকারব্যবস্থা কতটা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে, শেখ হাসিনার সরকার ছিল তার ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত। আমরা দেখেছি, গোষ্ঠীস্বার্থে কীভাবে সামষ্টিক স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। রাজনীতিবিদেরা যাঁদের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পান, তাঁদের স্বার্থই যে তাঁরা রক্ষা করবেন, সেটাই বাস্তব। এখানে অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।
ফলে দোষারোপ, যুক্তি–প্রতিযুক্তি ছেড়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই তাদের অর্থের উৎস পরিষ্কার করতে হবে। তাদের তহবিলে কোথা থেকে অর্থ আসছে, সেটা নাগরিকদের জানতে হবে। একটা অভ্যুত্থান হলো, এত মানুষ আত্মত্যাগ করল আর সবাই রূপকথার গল্পের মতো ভালো হয়ে গেল, সেটা অবাস্তব কল্পনা।
রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের উৎস, রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের টাকাটা কোথা থেকে আসছে, সেটা অবশ্যই জনগণকে জানতে হবে। সেটা পুরোনোদের ক্ষেত্রে যেমন, নতুনদের ক্ষেত্রেও তেমন।
রাষ্ট্রের মধ্যে ছোট ছোট রাষ্ট্র বানিয়ে জনগণের কাছ থেকে খাজনা তোলাটা বন্ধ করতেই হবে। অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলো আপনা–আপনি ভালো হয়ে যাবে, সেটা আশা করা বৃথা। এ ভূমির মানুষ বারবার এত এত রক্ত দেওয়ার পরও সেই ধারার পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু তারা যাতে জবাবদিহির মধ্যে ও নজরদারির মধ্যে থাকে, সেই ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। এখানে রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতায়ন হয়।
সেই ধারা বদলে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবশ্যই জনতাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎস কী, সেটা অবশ্যই জনগণকে জানতে হবে। কেননা, রাজনৈতিক দলগুলো যার নুন খাবে, তার গুণ গাইবেই। শেষপর্যন্ত তাদের স্বার্থেই কাজ করবে।
No comments