দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতায় সাত কাজ
দুনিয়াতে সবাই সফল হতে চায়। সবাই সুখী হতে চায়। দুনিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তির সফলতা ও সুখের মানদণ্ড হচ্ছে নিজের সব ধরনের মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়া। নিজের মনোবাঞ্ছা অনেক সময় এমন হয় যে, শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে তা গর্হিত কাজ। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে তা গর্হিত নয়। এমন মনোবাঞ্ছা পূরণ করে মানুষ দুনিয়াতে সুখী হতে পারে এবং নিজেকে সফল মনে করতে পারে। কিন্তু পরকাল বিবেচনায় তা মোটেও সফলতা নয়। বরং প্রকৃত সফলতা হচ্ছে পরকালের সফতা। আর পরকালের সফলতা অর্জনের জন্য কাজ করলে যেমন মৃত্যুপরবর্তী জীবন সুখের হয়, তেমনি দুনিয়াতেও পাওয়া যায় আত্মিক প্রশান্তি। দুনিয়াতে প্রশান্তি এবং পরকালে সফলতা অর্জন করতে সাতটি কাজের গুরুত্ব অনেক। সেগুলো তোলে ধরা হলো
এক. নামাজে খুশু-খুজু তথা বিনয়, নম্রতা ও স্থিরতা অবলম্বন করা। নামাজের অন্য রুকনগুলো হচ্ছে দেহের সমতুল্য, আর একনিষ্ঠতা ও খুশু-খুজু হচ্ছে প্রাণতুল্য। তাই নামাজের খুশু-খুজুকে মুমিনের সফলতার সর্বপ্রথম শর্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামের পাঁচ ভিত্তির দ্বিতীয়টি হলো নামাজ। নামাজ শারীরিক ইবাদত, যা ধনী-গরিব সকলের জন্যই ফরজ। হাদিসে নামাজকে বলা হয়েছে বেহেশতের চাবিকাঠি। সুতরাং নামাজ ছাড়া পরকালে জান্নাতে যাওয়ার চিন্তা করা যায় না। তাই নামাজের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া কাম্য। আর নামাজের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হবে তখনই যখন নামাজ খুশু-খুজুর সঙ্গে আদায় করা হবে।
দুই. অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মানুষ যখন অনর্থক কার্যকলাপ বর্জন করে তখন তার ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়।
অনর্থক কার্যকলাপ বলতে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ, অতিরিক্ত নিদ্রা, প্রাসাদ নির্মাণ, মাত্রাতিরিক্ত কাপড়চোপড় তৈরি সবকিছুই বোঝানো হয়েছে। মনে রাখতে হবে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অমূল্য সম্পদ। যারা সফল হতে চায়, তারা কখনও অহেতুক কাজে সময় ব্যয় করতে পারে না। তাই আসুন, আমরা অহেতুক কাজে সময় ব্যয় না করে ইবাদতে মনোযোগী হই। এতে আমরা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই সফল হতে পারব।
তিন. জাকাত প্রদান করা। জাকাত হচ্ছে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ। জাকাত মানুষের সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে, মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ করেন, ‘যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে সে সফলকাম হয়েছে, যে নিজের আত্মাকে কলুষিত করেছে সে ব্যর্থ হয়েছে।’ জাকাত ধনী গরিবের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে। এতে দেশে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
চার. যৌনাঙ্গকে হারাম থেকে হেফাজত করা। নিজ স্ত্রী ছাড়া সব পরনারী থেকে নিজেকে হেফাজত করা। অতএব বৈধ ক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক পন্থায় বা নিষিদ্ধ সময়ে কামবাসনা পূর্ণ করা হারাম। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। তাই এই বিষয়ে সতর্ক থাকা কাম্য। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের লজ্জাস্থান ও জিহ্বার হেফাজত করবে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর দায়িত্ব তিনি নেবেন।
পাঁচ. আমানতদারি রক্ষা করা। আমানত শব্দ দিয়ে ওই দায়িত্ব বোঝায়, যা এমন কোনো ব্যক্তি বহন করে যার ওপর আস্থা ও ভরসা করা হয়। আমানত শব্দটি বহুবচনে ব্যবহৃত হওয়ায় সব ধরনের আমানত এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এই আমানত আল্লাহতায়ালার হক সংক্রান্তও হতে পারে। যেমন ফরজ ও ওয়াজিব বিধিবিধানগুলো আদায় করা। হারাম ও মাকরুহ বিষয়াদি থেকে বিরত থাকা। বান্দার হক সংক্রান্তও হতে পারে। যেমন : কেউ কারও কাছে অর্থ-সম্পদ আমানত রাখল। তাহলে এই আমানত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত হেফাজত করা আমানতদারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ছাড়া কেউ কারও কাছে কোনো গোপন কথা বললেও কথাটি তার কাছে আমানত হিসাবে থাকে। শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া কারও গোপন কথা ফাঁস করাও আমানাতের খেয়ানত।
ছয়. অঙ্গীকার পূর্ণ করা। অঙ্গীকার বলতে এমন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বোঝায়, যা কোনো ব্যাপারে উভয় পক্ষ নিজের ওপর অপরিহার্য করে নেয়। এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ভঙ্গ করা বিশ্বাসঘাতকতা ও হারাম। একজন অন্যজনকে কিছু দেওয়ার কিংবা কোনো কাজ করে দেওয়ার একতরফা যে অঙ্গীকার করে, তাও পূর্ণ করা ওয়াজিব। এ সম্পর্কে হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওয়াদা হচ্ছে এক ধরনের ঋণ। ঋণ আদায় করা যেমন ওয়াজিব, ওয়াদা পূর্ণ করাও তেমনি ওয়াজিব।’
সাত. কাউকে কষ্ট না দেওয়া। মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনো দিনও সফল হওয়া যায় না। কেননা কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া জঘন্য অপরাধ। এমন অপরাধের ক্ষমা মহান আল্লাহ করবেন না। যাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। তাহলেই এমন অপরাধ থেকে ক্ষমা পাওয়া সম্ভব।
উল্লিখিত সাতটি কাজের মধ্যে কিছু কাজ আল্লাহতায়ালার হক সংক্রান্ত, কিছু কাজ বান্দার হক সংক্রান্ত। আর এই সাতটি কাজের মধ্যে শরিয়তের প্রায় মৌলিক বিধিবিধান চলে এসেছে। এই সাতটি কাজের গুণে গুণান্বিত লোকদের জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে। তবে তাদের জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী বলে এই দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির সম্পদ যেমন উত্তরাধিকারীদের হাতে আসার বিষয়টি সুনিশ্চিত, অনুরূপ এই সাতটি গুণের অধিকারী ব্যক্তিদেরও জান্নাত লাভের বিষয়টি সুনিশ্চিত।
No comments