প্রতিদিন চা পানে কী হয় ?
ওজন ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি মানসিক অবস্থা উন্নতিতে সব ধরনের চা প্রভাব ফেলে না। প্রাচীন পানীয়গুলোর মধ্যে চা একটি, যা বিশ্বের অনেক দেশের সংস্কৃতির সাথেও যুক্ত। অনেকেই প্রতিদিন সকালে, দুপুরে এবং বিকেলে চা পান পছন্দ করেন। তবে শুধুমাত্র চায়ের স্বাদই নয়, এর বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন চা পান করা শরীরের বিভিন্ন দিকের উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে। তবে অবশ্যই সেটি দুধ-চিনি যুক্ত চা নয়।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক
পুষ্টিবিজ্ঞানী অ্যামি গুডসন ইটদিস নটদ্যাট ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “কালো চা, গ্রিন টি এবং হিবিস্কাস চা (হার্বাল চা) হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে। রক্তচাপ ও এলডিএল কোলেস্টেরল (খারাপ কোলেস্টেরল) কমাতে এবং সার্বিক হৃদরোগের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক।”
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্যালেন্স ওয়ান সাপ্লিমেন্টের পুষ্টিবিজ্ঞানী ট্রিস্ট বেস্ট একই প্রতিবেদনে বলেন, “কালো চায়ে ‘থিয়াফ্লেইভিন্স’ এবং ‘থিয়ারুবিজিন্স’ নামে দুটি উপকারী যৌগ থাকে, যা খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।”
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে
চা শুধু শরীরের জন্য নয়, মস্তিষ্কের জন্যও উপকারী। অ্যামি গুডসন বলেন, “গ্রিন টি’তে ‘এল-থিয়ানাইন’ নামক অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা ক্যাফিনের সাথে মিলিত হয়ে সতেজতা ও মনোযোগ বাড়াতে সহায়তা করে।” “ক্যাফেইনযুক্ত চা, যেমন- ব্ল্যাক টি বা কালো চা, আমাদের সজাগ রাখতে এবং মনোযোগী করতে সাহায্য করে, যা মানসিক কার্যক্ষমতা বাড়ায়- বলেন এই মার্কিন পুষ্টিবিদ। তাই শুধু শরীরকেই নয় মানসিক ক্ষমতাকেও সক্রিয় রাখতে পারে চা।
চা হজমের উন্নতিতে সহায়ক
হজমের সমস্যা অনেকেরই রয়েছে, বিশেষত বাংলাদেশে যেখানে খাদ্যাভ্যাসের কারণে হজমজনিত সমস্যা সাধারণ। চা হজমের জন্য উপকারী হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পুষ্টিবিশেষজ্ঞ লিসা ইয়াং বলেন, “ক্যামোমাইল, পেপারমিন্ট, আদা এবং অন্যান্য ভেষজ চা গ্যাস, পেট ফাঁপা এবং অস্বস্তি কমাতে সহায়তা করে।” ট্রিস্ট বেস্ট মন্তব্য করেন, “ব্ল্যাক টি’তে ট্যানিনস নামক উপাদান থাকে, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য বজায় রাখাতে পারে। আর ভালো ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধিতে সহায়ক।”
অতিরিক্ত ক্যাফিন থেকে সাবধান
প্রতিদিন চা পান করার সময় ক্যাফিন সম্পর্কেও কিছু সতর্কতা থাকা উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন- যদিও চায়ে সাধারণত কফির তুলনায় কম ক্যাফিন থাকে। তবে অতিরিক্ত চা পানে ক্যাফিন গ্রহণের পরিমাণ বাড়তে পারে। তখন অস্বস্তি, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি এবং ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটা সত্যি যে, ব্ল্যাক এবং গ্রিন টি’তে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যাফিন থাকে, যা সতেজতার অনুভূতি দেয়। তবে অতিরিক্ত পান করার ফলে ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চা সঠিক পরিমাণে এবং দুপুর বা বিকেলের দিকে খাওয়ার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞরা, যাতে রাতে ঘুমের সমস্যা না হয়।
মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক
কিছু বিশেষ চা, যেমন- ক্যামোমাইল চা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। “ক্যামোমাইল চা একটি দেহে শিথিলকারী প্রভাব সৃষ্টি করে, কারণ এতে ‘এপিজেনিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট রিসেপ্টরের (বিশেষ সেল বা প্রোটিনকে বোঝানো হয় যা বিভিন্ন রাসায়নিক সংকেত বা সিগন্যাল গ্রহণ করতে সক্ষম) সাথে যুক্ত হয়ে উদ্বেগ কমায় এবং শিথিলতা তৈরি করে” ব্যাখ্যা করেন অ্যামি গুডসন। এছাড়া, “ক্যামোমাইল চা পান করলে ঘুমের মান উন্নত হতে পারে, কারণ এটি শরীরে শান্তির অনুভূতি তৈরি করতে সহায়ক”- বলেন ট্রিস্টা বেস্ট ।
বিপাক বা মেটাবলিজমের উন্নতি ঘটায়
‘জার্নাল অব রিসার্স ইন মেডিক্যাল সায়েন্স’য়ে প্রকাশিত ইরানের ‘তেহরান ইউনিভার্সিটি অফ মেডিকেল সায়েন্সেস’ পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রিন টি বিশেষভাবে বিপাক প্রক্রিয়াকে সমন্বয় করতে পারে। যা সরাসরি রক্তের শর্করা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত।
প্রদাহ কমাতে সহায়ক
বিশেষজ্ঞরা জানান, গ্রিন এবং ব্ল্যাক টি’তে প্রদাহ কমানোর শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা রক্ত কোষে প্রদাহ কমাতে সহায়ক। এছাড়া, চীনের ‘সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটি’র ‘স্কুল অফ পাবলিক হেল্থ’ পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, লুপাস রোগীদের (শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (ইমিউন সিস্টেম) তার নিজের স্বাস্থ্যকর কোষ এবং টিস্যুর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে) ওপর একাধিক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গ্রিন টি খাওয়ার পর তারা শরীরে কম প্রদাহ অনুভব করেছেন।
মূত্রের পরিমাণ বাড়াতে পারে
“ড্যানডিলিওন টি, গ্রিন টি, বার্লির চা এবং হিবিস্কাস টি- এগুলোতে মূত্র বর্ধক উপাদান রয়েছে” বলেন ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক পুষ্টিবিদ অ্যামান্ডা সেভিলা। এই উপাদান প্রস্রাবের মাধ্যমে দেহ থেকে লবণ ও পানি বের করে দেয়। তাই সেভিলা পরামর্শ দেন, “এই ধরনের চা বিকাল চারটার পর থেকে পান না করাই ভালো। না হলে, সারারাত বারবার ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যেতে হতে পারে।”
ওজন নিয়ন্ত্রণ
বিভিন্ন গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল হল, গ্রিন টি ওজন কমাতে সাহায্য করে। যেমন ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মলিকিউলার সায়েন্স’য়ে প্রকাশিত চীনের ‘সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটি’র ১২ সপ্তাহের গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়- গ্রিন টি পানের পর নারীদের পেটের আশপাশের চর্বি অনেকটাই কমতে দেখা গেছে।
কারণ হিসেবে জানানো হয়, গ্রিন টি পানের ফলে অংশগ্রহণকারীদের শক্তির মা্ত্রা (এনার্জি) বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি লিপিড উৎপাদন (খাবার থেকে পাওয়া চর্বি যকৃতের মাধ্যমে সংশ্লেষিত হওয়া) এবং বিপাক প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটেছে।
No comments