মাগুরার কন্যাশিশুটি জীবন দিয়ে কী শেখাল ?
মাগুরায় ধর্ষণের শিকার ৮ বছর বয়সী শিশুটি শেষ পর্যন্ত মারা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে। আসলে শিশুটি মারা যায়নি; তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। অতটুকু প্রাণ এত অত্যাচার সইবে কীভাবে?
৮ বছরের শিশুটি ৫ মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গভীর রাতে ধর্ষণের শিকার হয়। বোনের স্বামীর সহায়তায় বোনের শ্বশুর মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছিল। শিশুটির বোন ওই ধর্ষণের পূর্বাপর ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা সভ্য সমাজে কল্পনা করা কঠিন।
এ ঘটনার এক সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি অন্তত পাঁচ শিশুর ধর্ষণের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে; যেখানে অভিযুক্তদের কেউ ধর্ষণের শিকার শিশুর প্রতিবেশী, আবার কেউ নিকটাত্মীয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৩৯ জনের বয়স ৬ বছরের কম; ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিচিতদের দ্বারাই শিশুরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়। মূলত নিকটাত্মীয়ের প্রতি যে বিশ্বাস থাকে, তা ব্যবহার করেই এসব অপকর্ম হয়।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই; কিন্তু আদালতের নির্দেশনার পরও কমছে না নারীর প্রতি সহিংসতা। গত মাসেই ১০৭ নারী ও কন্যাশিশু নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এক মাসে ৫৩ জন ধর্ষণের শিকার, যাদের মধ্যে ৩৮ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ২৯১টি ঘটনা ঘটেছে, যা আগের মাসের তুলনায় ২২টি বেশি। এমএসএফ জানায়, জানুয়ারি মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১টি বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারিতে ৪২টি ধর্ষণ, ১৩টি দলবদ্ধ ধর্ষণ, ৩টি ধর্ষণ ও হত্যা, ১১টি ধর্ষণচেষ্টা, ৩২টি যৌন নিপীড়ন, ৩১টি শারীরিক নির্যাতন, ৩টি নির্যাতন ও ৭০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
মনে পড়ে, ২০১৬ সালে দিনাজপুরে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ৫ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সাইফুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আদালত থেকে জামিন নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছে সে। এ ঘটনায় ক্ষোভ সৃষ্টি হলেও আসামিকে আবার কারাগারে পাঠানোর মতো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ওই শিশুর বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আসামি চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে। স্ত্রী ও মেয়ে এখন ঘর থেকে বের হতে চান না।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনে গাজীপুরের শ্রীপুরে আরেকটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বনের ভেতর নির্জন স্থানে আরমান মিয়া নামে এক ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে তার ভিডিও ক্লিপ তিন বন্ধুকে পাঠিয়েছে। ওই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে এলাকাবাসী পুলিশের জিম্মায় দেন। একই দিনে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় মোজাম্মেল হক মানিক নামে এক শিক্ষক।
আমাদের দেশে ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুর পরিচিত; হয় তার আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ। শিশুদের ওপর ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়ন নিয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবইউজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাতেও বলা হয়েছে, দুর্বৃত্তরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর পরিচিত কেউ।
আমাদের আইনে ছেলেশিশু ধর্ষণের ব্যাপারে কিছু বলা নেই! আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ছেলেশিশুরা যে ধর্ষণের শিকার হতে পারে– এই ধারণাটাই স্বীকৃত নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২৪ সালেই ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি; ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে তিনটি। ছেলেশিশুরা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলেশিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও খুব কম ক্ষেত্রে এ নিয়ে সচেতনতা দেখা যায়।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটনের শিশুদের ওপর সংঘটিত যৌন সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই কথা বলা হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেও।
ফুলের মতো পবিত্র যেসব শিশুর আমাদের স্নেহ ও ভালোবাসা পাওয়ার কথা; কেন কেউ কেউ তাদের ভোগ্য ভেবে নেয়? এই যে এত এত দর্শন; কীসের অবক্ষয় আমাদের আজ খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে? এ জন্য মূল্যবোধের ক্রমাগত অবক্ষয়; পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন ও রাজনীতির অবক্ষয়ের পাশাপাশি মোটা দাগে শিশু পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতাই প্রকাশ পাচ্ছে এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে। আর এই শিশুরা বারবার জীবন দিয়েও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারছে না সমজের অবক্ষয়!
No comments