আড়ি পাতা ও নেট বন্ধের সুযোগ থাকছে স্টারলিংকে
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার বিষয় সরকারের জারি করা নির্দেশিকায় আইনসম্মত আড়িপাতার সুযোগের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে যখন তখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগও রাখা হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করলে সেখানেও আড়ি পাতার সুযোগ থাকবে।
দেশে স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা চালুর তোড়জোড় চলছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি স্টারলিংকের সেবা ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে চালু করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এর অংশ হিসেবে গত বুধবার ‘রেগুলেটরি অ্যান্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইনস ফর নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, বিগত সরকারের মতো যখন তখন যাতে ইন্টারনেট বন্ধ করা না যায়, সেজন্যই বাংলাদেশে স্টারলিংক আনা হচ্ছে।
নতুন নির্দেশিকায় ২৬(৪) অনুচ্ছেদে আইনানুগ আড়ি পাতা বা ল’ফুল ইন্টারসেপশনের সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, নির্ধারিত জাতীয় সংস্থার প্রয়োজন অনুসারে লাইসেন্সধারী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত তার ‘গেটওয়েতে’ প্রবেশাধিকার প্রদান করবে এবং আইনানুগ আড়ি পাতার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে লাইসেন্সধারী সরকারের নির্ধারিত সংস্থা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তথ্য প্রদান করবে। এ ধরনের তথ্য দেওয়ার জন্য লাইসেন্সধারীর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি থাকতে হবে।
বিটিআরসির নির্দেশিকার ১৬তম সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস অধ্যায়ে বলা হয়েছে, এই ব্যবস্থায় লিগ্যাল ইন্টারসেপশনের (আইনানুগ আড়িপাতা) ব্যবস্থা থাকবে। কোম্পানিগুলোর সিস্টেম এলআই কমপ্লায়েন্ট হতে হবে, অর্থাৎ সিস্টেমে আড়িপাতার মতো ব্যবস্থা রাখতেই হবে।
দেশে ইন্টারনেট সেবাসংক্রান্ত দুটি বড় বিতর্ক রয়েছে। একটি হলো আড়ি পাতার সুযোগ। অন্যটি ইন্টারনেট বন্ধের সুযোগ রাখা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার যথেচ্ছ আড়ি পেতে বিরোধী মত ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন করত। অন্যদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিকেন্দ্রিক ইচ্ছেমতো ইন্টারনেট বন্ধ করা হতো।
সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে নতুন নজির তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। জুলাই মাসে টানা ৫ দিন পুরো দেশ ইন্টারনেটবিহীন ছিল এবং টানা ১০ দিন মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপরও ছিল নিষেধাজ্ঞা। আগস্ট মাসে সরকার পতনের ঠিক আগেও ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল। আর নিয়মিত আড়ি পাতা হতো। স্টারলিংকের সেবা বাংলাদেশে চালুর খবরে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল যে এ ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট বন্ধ এবং আড়ি পাতার সুযোগ থাকবে কি না।
দেশের সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যদিও টেলিযোগাযোগ আইনের ৯৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে আড়ি পাতা যাবে।
বিটিআরসির নতুন নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্যাটেলাইট নির্ভর ইন্টারনেট সেবা দিতে প্রথমে যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। তারপর বিটিআরসির কাছে আবেদন করতে হবে বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, আবেদন ফি পাঁচ লাখ টাকা। লাইসেন্সের জন্য সিকিউরিটি ডিপোজিট দিতে হবে আড়াই কোটি টাকা। লাইসেন্স দেওয়া হবে ১০ বছরের জন্য, থাকবে বার্ষিক ফিও। যারা স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে শুধু আইওটি সার্ভিস দেবেন, তাদের জন্য বার্ষিক ফি ১০ হাজার ডলার। আর যারা স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড এবং অন্যান্য সেবা দেবেন, তাদের বার্ষিক ফি ৩০ হাজার ডলার।
নির্দেশিকার নেটওয়ার্ক ও অপারেশন অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে সেবা দিতে লাইসেন্সধারীকে অন্তত একটি গেটওয়ে দিয়ে সংযুক্ত করতে হবে। লাইসেন্সধারী তার এনজিএসও গেইটওয়ে দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেইটওয়ে বা আইআইজি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত করে ইন্টারনেট ট্রাফিক পরিবহন করবে।
নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, সেবাদাতাকে প্রথম দুই বছর বিটিআরসির সঙ্গে কোনো রাজস্ব ভাগাভাগি করতে হবে না। তবে তৃতীয় বছর থেকে ৩ শতাংশ হারে এবং ষষ্ঠ বছর থেকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব ভাগাভাগি করতে হবে। আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে ১০ বছরের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হবে এবং তাদের কার্যক্রম চালাতে হবে অন্তত ৫ বছর।
স্টারলিংক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা স্পেসএক্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এটি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ইন্টারনেট-সেবা দেয়। ইলন মাস্কের সঙ্গে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ভিডিও কলে স্টারলিংক প্রসঙ্গে আলোচনা করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
দ্রুতগতির স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংকের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকায়। এ সময় ২৩০ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি পাওয়া গেছে। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলের বিদেশি স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাটির ব্রডব্যান্ড গেটওয়ে ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত সোমবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে ঢাকায় স্টারলিংকের গতির তথ্য জানিয়ে একটি পোস্ট দেন। সেখানে দেখা যায়, এর ডাউনলোড গতি ছিল ২৩০ এমবিপিএস। আপলোড গতি ২০ এমবিপিএস। এর সংযোগের সার্ভার ছিল সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ে। ক্লায়েন্টের অবস্থান দেখায় মালয়েশিয়ায়।
ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের প্রতিষ্ঠান ওকলায় দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ডের ডাউনলোড গতি ছিল ৫৩ দশমিক ১২ এমবিপিএস এবং আপলোড গতি ছিল ৪৯ দশমিক ২১ এমবিপিএস। মোবাইল ইন্টারনেটে ফেব্রুয়ারি মাসে ডাউনলোড গতি ছিল ৩৭ দশমিক ৯৮ এমবিপিএস এবং আপলোড গতি ছিল ১৩ দশমিক ৩০ এমবিপিএস।
No comments